আমাদের দেশের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তান–সন্ততিদের জন্য ছোটবেলা থেকেই প্রথাগত স্কুলশিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করে থাকেন। গান শেখা, ছবি আঁকা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় আমাদের কোমলমতি শিশুরা। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের কারণে বর্তমানে সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে প্রোগ্রামিং শেখার বিষয়টিও।
ইংরেজিতে ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ বা ‘ফোমো’ নামে একটি কথা আছে। এটি এমন এক অস্বস্তিকর অনুভূতি, যাতে মনে হয় কিছু তথ্য, ঘটনা বা অভিজ্ঞতা অজানা থেকে যাচ্ছে, যেগুলো জানলে অর্থাৎ ‘মিস’ না হলে জীবনটা আরও ভালো হতে পারত। প্রোগ্রামিং না জানা নিয়ে এখন অনেকের, বিশেষ করে অভিভাবকদের, এ ‘ফোমো’ অনুভূতি হচ্ছে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের প্রশ্ন-উত্তরের ওয়েবসাইট ‘স্ট্যাক ওভারফ্লো’ ডেভেলপার সমীক্ষা ২০২০ অনুসারে, শতকরা ৫৪ ভাগ পেশাদার ডেভেলপার ১৬ বছর বয়সের আগেই তাঁদের প্রথম লাইন কোড লিখেছেন, শতকরা ৩৫ ভাগ লিখেছেন ১৩ বছর বয়সের আগে। ১০ বছর বয়সের আগেই লিখেছেন শতকরা ৮ দশমিক ৯ ভাগ ডেভেলপার।
২০২৪–এর সমীক্ষা অনুযায়ী, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৯ ভাগ জানিয়েছেন, তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই প্রোগ্রামিং বা কোড লিখতে শিখেছেন। শতকরা ৩৫ দশমিক ৫ ভাগ শিখেছেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ জানিয়েছেন, তাঁদের কোডিং শেখার অন্যতম উৎস ছিল ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের অনলাইন কনটেন্ট।
প্রথমে একটু বলার চেষ্টা করি ‘প্রোগ্রামিং’ আসলে কী! সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা যদি কাউকে দিয়ে কোনো একটি কাজ করিয়ে নিতে চাই, নির্দেশ বা অনুরোধ জানাতে চাই, সে ক্ষেত্রে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলে কাজটি বুঝিয়ে দিই। যিনি কাজটি করবেন, তিনি যদি বাংলা ভাষা বোঝেন, তাহলে আমরা বাংলায় কথা বললেই হলো। কিন্তু দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে যদি দেখা যায় শ্রোতা শুধু ইংরেজি বোঝেন, তাহলে ইংরেজিতেই নির্দেশনা দিতে হবে, অন্যথায় তিনি কী করতে হবে বুঝতে পারবেন না এবং কাজটিও সম্পন্ন হবে না।
কম্পিউটারও আমাদের জন্য অনেক ধরনের কাজ করে দেয়। কম্পিউটার (যন্ত্র) বাংলা-ইংলিশ কিছুই বোঝে না। তবে এটিরও নিজস্ব ভাষা আছে। কেবল সে ভাষায় নির্দেশ দিলে কম্পিউটার সেটি পালন করতে পারবে, সে অনুযায়ী আমাদের জন্য কাজটি করে দিতে পারবে। একেবারে কম কথায় বললে, যন্ত্রের সে ভাষার নামই ‘প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’।
সবার কি যন্ত্রের সে ভাষা শেখার দরকার আছে? যাঁরা ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়বেন না বা ক্যারিয়ার গড়বেন না, তাঁদেরও কি প্রোগ্রামিং শিখতে হবে?
একটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া যাক। ইংরেজি বা চায়নিজ ভাষা না শিখলে জীবন থেমে থাকবে না। কিন্তু যদি চীন দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়, কথা বলতে হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হয়, তাহলে সে ভাষা শেখা থাকলে যে কাজের গতি বেড়ে যাবে, সেটি সহজেই বোধগম্য। বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় প্রায় সব বিষয়ে কম্পিউটারনির্ভর বেশ কিছু সফটওয়্যার বা সিস্টেম ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়।
সেসব ক্ষেত্রে প্রোগ্রামিংয়ের জ্ঞান থাকলে কাজগুলো করাটা অনেক সহজতর হয়। ব্যাপারটা সেই প্রাইমারি স্কুল থেকেই আমাদের আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখার মতো, যাতে করে সারা বিশ্বে যোগাযোগের কাজটি করা যায়। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজও কম্পিউটারের বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেটি শেখা থাকলে ভবিষ্যতে কাজে আসতে পারে।
অন্যদিকে কেউ ইংরেজির ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতেই পারেন, তার মানে এই নয় যে ইংরেজি মাধ্যমে অনুষ্ঠিত রসায়নবিজ্ঞানের আলোচনার জন্যও তিনিই উপযুক্ত। বরং রসায়নবিজ্ঞানে বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন কেউ, যিনি মোটামুটি ইংরেজি ভাষা জানেন, তিনিই এই কাজের জন্য অধিকতর উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন। একইভাবে কেউ কম্পিউটারবিজ্ঞানী বা সফটওয়্যার প্রকৌশলী হলেই শুধু প্রোগ্রামিংয়ের ব্যবহার আছে দেখেই অন্য কার্যক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত হয়ে যান না, বরং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন কেউ যদি প্রোগ্রামিংটা আয়ত্ত করে নিতে পারেন, তিনিই উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন।
আরেকটি প্রশ্ন, কারও যদি প্রোগ্রামিং শিখতে ভালো না লাগে, তাকে কি জোর করার প্রয়োজন আছে? এককথায় উত্তর হচ্ছে, প্রয়োজন নেই। কারও গান শিখতে ভালো না লাগলে, ছবি আঁকতে ভালো না লাগলে জোর করে সেটি কতটুকু করানো যায়? অনেক ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে মাত্র একটি হলো প্রোগ্রামিং। একেকজন শিশু একেক ধরনের কাজে আনন্দ পাবে। কেউ হয়তো ধাঁধা সমাধান করতে পারে, কারও হয়তো অঙ্ক করতে ভালো লাগে, কারও হয়তো হাতে-কলমে কোনো একটি কাজ শিখতে ভালো লাগে, কারও হয়তো ভালো লাগে বিতর্ক করতে, কেউ হয়তো চাইবে স্কাউটে অংশগ্রহণ করতে। এমনও হতে পারে, এখন প্রোগ্রামিং ভালো লাগছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে কাজের জন্য দরকার হলে তখন শিখে ফেলল।
অতএব, কেউ প্রোগ্রামিং না জানার মানে বর্তমান থেকে পিছিয়ে যাওয়া নয়, ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ অনুভূতির কারণ নেই। এনভিডিয়ার সিইও সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘প্রোগ্রামিং এখন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই কোডিংয়ের কাজ অনেকখানি করে ফেলবে। মানুষ বরং মনোযোগ দিতে পারে জীববিজ্ঞান, শিক্ষা, উৎপাদন বা কৃষিকাজের মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।’
● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক