কয়েক দিন আগে একটি কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম। চা–বিরতি হতেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন এক অংশগ্রহণকারী। বেশ উৎসাহ নিয়ে তিনি পরিচিত হলেন আমার সঙ্গে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমি শুনেছি, আপনি আগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। সরকারি চাকরি ছাড়লেন কেন জানতে পারি?’ এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে প্রায়ই হতে হয়। উত্তরে আমি আমার ব্যক্তিগত ভালো না লাগার কথা জানাতেই প্রশ্নকারী বললেন, দয়া করে এ কারণটা আর কাউকে বলবেন না।
জানতে চাইলাম, কেন? উত্তরে তিনি বললেন, এত দামি একটি চাকরি শুধু ব্যক্তিগত ভালো না লাগার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন জানলে সবাই আপনাকে বোকা বলবে।
এ ধরনের মন্তব্যও যেহেতু আমার জন্য নতুন নয়; তাই অনেকটা নির্লিপ্তভাবেই বললাম, এখানে বোকামির কী আছে? প্রত্যেকটি মানুষই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত মতামত আছে, আছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। আর সরকারি চাকরিই জীবনের একমাত্র গন্তব্য, এমন তো নয়। এই চাকরি ছাড়াও জীবন সুন্দর ও অর্থবহ হতে পারে। এরপর তিনি বললেন, ‘আজ আপনি সরকারি চাকরিতে থাকলে আমাদের সঙ্গে নয়; বরং সামনের ওই সংরক্ষিত চেয়ারে বসতেন।
এর পরও আপনার সিদ্ধান্ত বোকামি নয় বলছেন?’ উত্তর দিলাম, ‘কর্মক্ষেত্রের সাফল্য সব সময় চেয়ারের অবস্থান কিংবা মাপকাঠিতে কি বিচার করা যায়? চেয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে তখনই, যখন তা যোগ্য ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে। নতুবা চেয়ারের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, সে চেয়ারের মূল্য বাড়বে না কিছুতেই।’ সেই ব্যক্তি কতটুকু মানলেন জানি না; কিন্তু তিনি আর কথা বাড়ালেন না। সরকারি চাকরি নিয়ে অধিকাংশের মতামত অনেকটা এ রকমই। প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা সরকারি চাকরি যেন এক সোনার হরিণ। কারও কাছে এ শুধুই এক মরীচিকা।
সম্প্রতি দেশজুড়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা যেন কাটতেই চাইছে না। নানা কারণেই সময়টি ঘটনাবহুল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একে একে দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন স্কিম নিয়ে ধর্মঘট, সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন, বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেংকারি—সবকিছু মিলিয়ে যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবিটি যৌক্তিক সন্দেহ নেই। আমরা জানি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছে এক মাসের জন্য। আশা করি, দ্রুতই সমস্যাটির সমাধান হবে।
যতই দিন যাচ্ছে, ততই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি দেশের সামগ্রিক চিত্র নির্লজ্জভাবে বের হয়ে আসছে। প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থ কেলেংকারী, অর্থ পাচারসহ নানা ধরনের অপকর্মের খবর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। এসব দেখেশুনে সাধারণ মানুষদের সরকারি চাকরির প্রতি বিমুখ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। বাস্তবতা হলো, দিন দিনই সরকারি চাকরির প্রতি মোহ বাড়ছে, বাড়ছে প্রতিযোগিতা। লুটপাট আর দুর্নীতির এই চিত্র কিছুমাত্র প্রভাব ফেলছে না তরুণ প্রজন্মের ওপর।
ফলে তা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে না। না হলে ফি বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি আর এবং চাকরিজীবনে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা জেনেও কেন তাঁরা সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন? অর্থাৎ আজকের তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তুতি নিয়েই নিজেদের প্রস্তুত করছেন সরকারি চাকরির জন্য। তাই তো বিচ্ছিন্ন কিছু ইস্যুতে প্রতিবাদ করা ছাড়া অন্য কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের শামিল হতে দেখিনি।
উল্টো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূনে৵র মতো তাঁরা সরকারি চাকরির যুদ্ধে শামিল হচ্ছেন। কয়েক দিন আগে কোটা আন্দোলনের মধ্যে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আটকা পড়েছিলাম। সে সময় কিছু ছাত্রের সঙ্গে কথা বলা ও তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, সেখানে তাঁদের মধ্যে যতটা না কোটা সংস্কার আর বৈষম্যের প্রতি প্রতিবাদের আকুতি দেখেছি, তার চেয়েও বেশি অনুভব করেছি সরকারি চাকরি লাভের প্রতি তীব্র মোহ। প্রশ্ন হলো, কেন তাঁরা সরকারি চাকরি লাভের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছেন? দুর্নীতিতে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষস্থান ধরে রাখা একটি দেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়া কি এতটাই সুখকর? কে তাঁদের এই স্বপ্ন দেখাচ্ছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অবশ্য কঠিন নয়। সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ক্ষমতার প্রদর্শনী; আর তাঁদের গড়ে তোলা সম্পদের নিরাপদ পাহাড় তরুণ প্রজন্মকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাঁরা সরকারি চাকরি লাভের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। সরকারি চাকরির প্রতি আকণ্ঠ পিপাসা তাঁদের অনেক সৃজনশীল কর্মস্পৃহা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সরকারি চাকরিই যেন তাঁদের জীবনের একমাত্র গন্তব্য। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে, কোটাবিরোধী আন্দোলনটি এ পর্যায়ে আসার পেছনে শুধু কোটাব্যবস্থাকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার দাবিটিই নেই; সঙ্গে বারুদের মতো কাজ করছে সরকারি চাকরি লাভ করার মরিয়া আকুতি। কারণ কোটায় সংরক্ষিত আসনসংখ্যা কমে যাওয়ার অর্থ হলো, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি লাভের সম্ভাবনার পথটি প্রশস্ত হওয়া।
সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি চাকরি লাভ, অতি প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে ওঠা, সবই যেন লাভ-ক্ষতির বাণিজ্যের জটিল হিসাব–নিকাশ। একদিকে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষমতার আতশবাজি, আর অন্যদিকে বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে ধনসম্পদের নিরাপদ পাহাড় গড়ে তোলার আকর্ষণীয় প্যাকেজটি সম্ভবত আর কোনো চাকরিতে নেই। ফলে অন্য চাকরিতে বেতন বা পদবি যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন; সরকারি চাকরির তুলনায় তা জৌলুশহীন।
ফলে তা তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে না। না হলে ফি বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি আর এবং চাকরিজীবনে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা জেনেও কেন তাঁরা সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন? অর্থাৎ আজকের তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তুতি নিয়েই নিজেদের প্রস্তুত করছেন সরকারি চাকরির জন্য। তাই তো বিচ্ছিন্ন কিছু ইস্যুতে প্রতিবাদ করা ছাড়া অন্য কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের শামিল হতে দেখিনি।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতায়ন’ হলো একটি প্রক্রিয়া; যা প্রজাতন্ত্রের মানুষকে ক্ষমতায়িত করে সুস্থ–সুন্দর জীবনযাপনের জন্য এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সব অধিকার আদায় ও সুযোগ–সুবিধা ভোগ করার জন্য।
দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের ক্ষেত্রে জনগণ ক্ষমতায়িত না হয়ে উল্টো ক্ষমতায়িত হয়েছেন শুধু প্রক্রিয়াটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা। ক্ষমতা এখানে কতিপয় ব্যক্তির ভিআইপি হয়ে ওঠা, সামনের সারির আসন দখল করা কিংবা নিরাপদ আর্থিক ভবিষ্যৎ গড়ার মধ্যে বাক্সবন্দী হয়ে পড়েছে। কেউ কি নেই এখানে যে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে ‘ক্ষমতা’ নিয়ে গড়ে ওঠা মিথ্যার সব আয়োজন?
নিশাত সুলতানা
লেখক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]