সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেটার প্রধান ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের ফ্যাক্টচেকিং প্রোগ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত অনলাইনে সত্যবিহীন এক যুগের সূচনা করছে।
সমাজের আয়নায় দেখা হাস্যকর এক বিকৃত প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাজ করেছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সর্বদা অনলাইনে থাকি আমরা। এর অ্যালগরিদম আমাদের জীবনের খারাপ দিকগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরে। আড়ালে থাকে ভালো দিকগুলো। এ কারণেই আমরা আজ এতটা বিভক্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুটি দল পরস্পরের বিরুদ্ধে চিৎকার করে, যেন তারা এক বিশাল হতাশাজনক শূন্যতার মধ্যে পড়ে গেছে।
এই সপ্তাহে এক ‘প্রযুক্তিদানবের’ এ ঘোষণা তাই খুবই উদ্বেগজনক। 'যাহারা এইখানে প্রবেশ করিবে, ত্যাগিয়া আসিবে সকল আশা'! ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তার দুই সপ্তাহ আগে মেটা, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও থ্রেডসের মূল কোম্পানি বড় পরিবর্তন এনেছে কনটেন্ট মডারেশনে। মনে হচ্ছে, কোম্পানিটি আসন্ন প্রেসিডেন্টের মতাদর্শের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে।
গত মঙ্গলবার মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে একটি অদ্ভুত ভিডিও বার্তা দিলেন। ঘোষণা করলেন, মেটা যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্টচেকারদের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাদের পরিবর্তে কী আসছে? মবের শাসন।
মার্ক জাকারবার্গের পরিচালিত প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে তিন বিলিয়নের বেশি মানুষ বিভিন্ন অ্যাপে লগইন করেন। সেখানে এখন থেকে ইলন মাস্কের মতো ‘কমিউনিটি নোটস’ ফরম্যাটে নিয়ন্ত্রণ করা হবে কী ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে আর কী ধরনের নয়। এখন থেকে যে যত বেশি চিৎকার করবে, তারা তত বেশি জায়গা পাবে।
মেটার সিইও স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ‘আমাদের মুক্তমত প্রকাশের শিকড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে’, বলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ইমিগ্রেশন বা লিঙ্গ নিয়ে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো মূলধারার মতামতের সঙ্গে আর মেলে না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণা এখন ধ্বংসের পথে। বস্তুনিষ্ঠতা আগে থেকেই কোনোমতে টিকে ছিল লাইফ সাপোর্টে নিয়ে। মেটা স্বাধীন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করে সত্যের একটি অংশ ধরে রাখার চেষ্টা চালু রেখেছিল। তা অন্তত রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত ছিল।
জাকারবার্গ অতীতের ‘সেন্সরশিপ ভুল’-এর কথা স্বীকার করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করবেন, যাতে ‘বিদেশি সরকারগুলো আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি সেন্সর করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে না পারে’।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক কথাটি জাকারবার্গ কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন। মেটা তাদের ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটি টিম এবং কনটেন্ট মডারেশন টিমকে লিবারেল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান রাজ্য টেক্সাসে স্থানান্তর করবে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, এই ভিডিওতে জাকারবার্গ শুধু অন্ধ ট্রাম্পভক্তের মতো মাথায় একটা মার্কামারা টুপি পরে হাতে একটা শটগান রাখাই বাকি রেখেছেন।
সব ব্যবসায়ীই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চতুর কিছু পদক্ষেপ নেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধেয়ে আসা ট্রাম্প নামক ঝড়ের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগের সামনে মেটার এই পদক্ষেপ খুব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কিন্তু কিছু মানুষের সিদ্ধান্ত অন্য অনেকের সিদ্ধান্তের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্ক জাকারবার্গ সেই অল্প কিছু মানুষের মধ্যে একজন।
গত ২১ বছরে মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ নিজেকে সমাজের কেন্দ্রীয় অংশে নিয়ে এসেছেন। শুরুতে তিনি এমন একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করতেন, যা কলেজশিক্ষার্থীরা ব্যবহার করত। এখন এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরের জন্য একটি অপরিহার্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২০০০ সালের শুরুর দিকের একটি ছোটখাটো অনলাইন বিনোদনের পোর্টাল এখন অপরিহার্য ময়দান হয়ে উঠেছে। এখানে আমরা সবাই প্রতিদিন আসি। না এলে আমাদের মধ্যে আর যোগাযোগ থাকে না। আমরা দুনিয়া থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। মেটা যে পথে হাঁটে, অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্ব সেই পথ অনুসরণ করে। আর মেটা এখন ডানপন্থার দিকে একটি নাটকীয় নতুন পথ বেছে নিয়েছে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা বিভক্ত হয়ে আছি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা একটি জিনিস শিখেছি, যারা সবচেয়ে বেশি রাগী, বেশি চেঁচামেচি করতে পারে, তারাই এখানে তর্কে জেতে। ক্রোধ ও মিথ্যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্মগুলোর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে কিছু মাত্রায়। মেটা মাত্র চার বছর আগে ৬ জানুয়ারি ২০২১-এ ক্যাপিটলে সংঘটিত সহিংসতায় উসকানির অভিযোগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম থেকে দুই বছরের জন্য বরখাস্ত করেছিল।
সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো সব সময়ই তাদের প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে সমস্যায় পড়েছে। তারা শুধু একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে তারা কোনো বিতর্কে যে পক্ষই নিক, অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ এর উল্টো দিকে যাবে। তবে তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে ব্যবসা বাড়ানোর জন্যই যা করার করেছে। অন্য দিকে যথেষ্ট বিনিয়োগ তারা করেনি। প্ল্যাটফর্মগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে কার্যকর কনটেন্ট মডারেশন এমন এক সমস্যা, যার মীমাংসা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সমস্যা তো তারা নিজেরাই তৈরি করেছে যেকোনোভাবে ব্যবহারকারী বাড়ানোর ধান্দায়।
অবশ্যই অনলাইনে আলোচনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আর মেটার মতো কোম্পানিগুলো যে কনটেন্ট মডারেশন চালু করতে চেষ্টা করেছে, তা কার্যকর হয়নি। তবে তাই বলে মডারেশন পুরোপুরি পরিহার করে কমিউনিটি নোটসকে গ্রহণ করা সমাধান নয়। এই সপ্তাহে জাকারবার্গ তাঁর বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণী প্রধান হিসেবে নিজেকে র্যাডিক্যাল মধ্যপন্থী দাবি করা নিক ক্লেগের জায়গায় একজন রিপাবলিকানপন্থীকে নিয়োগ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ডানা হোয়াইটকে মেটার বোর্ডে নিয়ে এসেছেন। এসব ঘটনা থেকে আড়াল করা সত্যটা বোঝা যায়। এসব আসলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়ার প্রয়াস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণা এখন ধ্বংসের পথে। বস্তুনিষ্ঠতা আগে থেকেই কোনোমতে টিকে ছিল লাইফ সাপোর্টে নিয়ে। মেটা স্বাধীন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করে সত্যের একটি অংশ ধরে রাখার চেষ্টা চালু রেখেছিল। তা অন্তত রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত ছিল।
এখন দিনকে রাত বলা হচ্ছে, উল্টোকে বলা হচ্ছে সোজা। মেটা হয়ে উঠেছে অজানা এক শক্তি। মার্ক জাকারবার্গ হয়ে উঠেছেন ইলন মাস্ক। প্রস্তুত থাকুন—সামনের চার বছর হবে উত্তাল, বিষাক্ত ও সত্যহীন এক অনলাইন সময়।
ক্রিস স্টোকেল-ওয়াকার, লেখক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন