এটি এখন নিশ্চিত যে বিএনপি এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলকে ছাড়াই আগামী ৭ জানুয়ারি আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে আমরা একতরফা নির্বাচন দেখেছি। পরবর্তী সময়ে কতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা দেখেছি একধরনের সাজানো নির্বাচন, যা ছিল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহৃত কৌশলের পূর্বাভাস। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়, যার পরিণতি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার, এমনকি ক্ষমতাসীনদের জন্যও মঙ্গলকর হয়নি। ফলে আবারও একটি একই ধরনের নির্বাচন হলে তার পরিণতিও কোনোভাবেই শুভ হবে না।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে খুলনা থেকে শুরু করে পাঁচটি সিটি করপোরেশনে একপ্রকারের নিয়ন্ত্রিত, তথা সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাকে আমি ‘খুলনা মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। এসব নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য ছিল—
১. নির্বাচনের সময়ে পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁদের ঘরছাড়া করা, যাতে তাঁরা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা না চালাতে পারেন।
২. নির্বাচনের দিন ভয়ভীতি দেখিয়ে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে আসতে বা থাকতে না দেওয়া।
৩. ভোটকেন্দ্রের সামনে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে বিরোধী দলের সমর্থকেরা ভোট প্রদানে বিরত থাকেন।
৪. ভোট গ্রহণ চলাকালে কিছু দুর্বৃত্তের ঝটিকাবেগে এসে ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে উধাও হয়ে যাওয়া।
৫. এসব নির্বাচনী অপরাধ সম্পর্কে হুদা কমিশনের সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকা। বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ থাকলেও এসব সাজানো নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না; ফলে সিলেট ছাড়া অন্য সব সিটিতেই ক্ষমতাসীনেরা বিএনপির মেয়রদের পরাজিত করে।
সিটি নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দলীয়করণ এবং অসাংবিধানিকভাবে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের বিধান করায় বিএনপি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে ক্ষমতাসীনেরা তাদের সাজানো নির্বাচনের মডেলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে—
১. নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী সব দলের সঙ্গে সংলাপ করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের উপস্থিতিতে বা সহায়তায় ঐক্য ফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংস আক্রমণ চালায়, যার ফলে তারা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে, এমনকি কোনো কোনো প্রার্থী তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেননি।
৩. মনোনয়নপত্র বাছাইপর্বে নির্বাচন কমিশন ৭৮৬ জনের প্রার্থিতা বাতিল করে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ঐক্য ফ্রন্টের প্রার্থী।
৪. আপিল প্রক্রিয়ায় আদালত কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়াসহ ঐক্য ফ্রন্টের অনেকের প্রার্থিতা বাতিলের কারণে ১৮টি আসনে তাদের কোনো প্রার্থী ছিলেন না।
৫. নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ প্রদানের প্রাক্কালে পুলিশ সম্ভাব্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করে।
৬. পুলিশ বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য গায়েবি মামলা করে, যাতে তাঁরা নির্বাচনের দিন হয় জেলে, না হয় নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকতে বাধ্য হন।
৭. ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক, একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে নির্বাচনের আগের রাতে সিলমারা ব্যালট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেন।
৮. নির্বাচনের দিনে সরকারি দলে কর্মীরা অনেক নির্বাচনী এলাকায় কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেন।
৯. দিনের শেষে ব্যালট পেপার গণনা না করেই ফলাফল ঘোষিত হয়, ফলে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ও কিছু কেন্দ্র শতভাগের বেশি ভোট পড়ে এবং বিএনপি ১ হাজার ১৭৭ কেন্দ্রে, এমনকি সরকারি দলও ২টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পায় এবং ক্ষমতাসীন দল ও তার জোটসঙ্গীরা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টিতেই ‘জয়লাভ’ করে। সাজানোর নির্বাচনের এসব অপকৌশলের কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না।
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপশাসন, নাগরিক অধিকার হরণ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পরাজয় এড়াতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকেই দূরে রাখাতে ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের সাজানো নির্বাচনের কৌশলে আরও পরিবর্তন আনেন। এ কৌশলের লক্ষ্য হলো—
১. আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান।
২. অনেক সক্রিয় দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি ‘কিংস পার্টিকে’ নিবন্ধিতকরণ।
৩. বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতাকে কাজে লাগিয়ে পুলিশকে দিয়ে অসংখ্য মামলা দায়েরের মাধ্যমে তাদের ২০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং অনেককে ঘরছাড়াকরণ, যাঁদের মধ্যে দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতা অন্তর্ভুক্ত।
৪. রাজনৈতিক হয়রানির দায় নির্বাচন কমিশন নেবে না বলে ঘোষণা প্রদান, যা পুলিশকে বিরোধী দলের দমন-পীড়নে আরও উৎসাহিত করে।
৫. অতীতের অনেক মামলাকে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে সচল করে নিম্ন আদালতের মাধ্যমে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে সাজা প্রদান।
৬. দুর্বৃত্তদের দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা করিয়ে একটি চরম ভয়ের আবহ তৈরি
৭. আইনশৃঙ্খলা ও বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় বিএনপির অনেক নেতাকে ভাগিয়ে এনে কিংস পার্টিতে বা ক্ষমতাসীন দলে যোগদানের আয়োজন।
৮. বিশেষ বাহিনীর তৎপরতার কারণে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা প্রদান।
৯. নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ডামি প্রার্থী সৃষ্টি ও নিজ দলের অন্যদের নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিতকরণ।
এসব ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ কারণে আমরা আবারও পুরোনো কায়দায় একটি একতরফা নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে কিছু কিংস পার্টি ও কয়েকটি কম গুরুত্বপূর্ণ দলের মনোনীত ক্ষমতাসীনদের কিছু পছন্দের এবং আওয়ামী লীগেরই দলীয় ডামি ও অন্য প্রার্থীদের। এ ধরনের নিজেদের এবং নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের মধ্যকার প্রতিযোগিতাকে কি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন বলা যাবে?
কারসাজির মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে আমাদের আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার একদলীয় নির্বাচনের কোনোরূপ গুণগত পার্থক্য কি আর রইল?
ব্ল্যাকস ল ডিকশনারি অনুযায়ী, নির্বাচন হলো বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। আর এ বিকল্প হতে হবে যথার্থ। তাই জেনুইন বা সত্যিকারের নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন ভোটার, তাদের বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ, যে বিকল্প হবে যথার্থ, বিকল্পের জন্য সমতল নির্বাচনী মাঠ এবং ভোটারদের প্রভাবমুক্ত হয়ে বেছে নেওয়ার অধিকার।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ব্র্যান্ড—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নির্বাচনে বিএনপি না থাকলে, দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল অনেকাংশেই পূর্বনির্ধারিত—এতে আওয়ামী লীগই, বিশেষ কোনো কৌশলের আশ্রয় না নিলে, সব আসনেই জিতবে, তা প্রায় নিশ্চিত। এমন সাজানো নির্বাচনে উত্তর কোরিয়ার মতো ৯৯ শতাংশ ভোট পড়লেও এটিকে জেনুইন নির্বাচন বলা যাবে না, বরং এটি হবে জনগণের সঙ্গে মশকারার বা প্রতারণার শামিল।
এ ধরনের নির্বাচন আমাদের জন্য অর্থনৈতিক চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নতুন সরকার তার ‘লেজিটিমেসির’ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য অন্য রাষ্ট্রের ওপর আরও নির্ভরশীল হতে বাধ্য হতে পারে। এতে আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। আবারও ভোটাধিকার হরণ করা হলে নাগরিকদের মধ্যে বিরাজমান ‘এলিনিয়েশনের’ বা মালিকানা-হীনতার মনোভাব আরও প্রকট হতে পারে। সর্বোপরি আবারও ভোটাধিকার হরণের কারণে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত জনরোষের অস্বাভাবিক প্রকাশ ঘটতে পারে। কারণ অধিকারবোধ বিলীন হয়ে যায় না, বরং দিন দিন তা আরও ব্যাপক ও প্রকট হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)