চীনা শাসকেরা ভারতকে নিয়ে একটু তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করে। ভারতের দাঙ্গা-হাঙ্গামাময় রাজনীতি, নড়বড়ে অবকাঠামো কিংবা দারিদ্র্য; প্রায়ই তাদের উপহাসের শিকার হয়। অন্যদিকে চীনের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতেও একসময় ভয় ছিল, ঈর্ষা ছিল। আর ছিল তাদের সমান হওয়ার অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এখন হিমালয়ের নিচে যে টেকটনিকগুলো আছে, সেগুলো নড়াচড়া শুরু করছে। একদিকে সীমান্তে রক্ত ঝরছে, অপর দিকে ক্রমে দৃঢ় হতে থাকা তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে এবং সেটা এতই ভিন্ন যে, পশ্চিমের কাছে তা অশনিসংকেত হিসেবে প্রতিভাত হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে যখন চীন ভ্রমণ করেন, চীনা বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে খুব একটা পছন্দ করেননি। গুরুদেব ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কড়া সমালোচক ছিলেন বলে এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যকার পুরোনো বন্ধন ও ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেই সময়কার চীনা বুদ্ধিজীবীরা কবিগুরুর এই আকাঙ্ক্ষা মোটেও গুরুত্ব দেননি। তাঁরা মনে করতেন, পশ্চিমকে ঠেকাতে হলে পশ্চিমের শিক্ষা গ্রহণ করেই তাকে ঠেকাতে হবে, সেখানে প্রাচীন সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য তেমন কাজে আসবে না। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা চেন ডুশিউ বলেছিলেন, ‘চীনা যুবাদের ভারতীয় হয়ে ওঠা মোটেও কাম্য নয়।’
প্রায় এক শ বছর পরও চীনা কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীরা ভারতকে এখনো তাদের পশ্চাৎপদ বলেই মনে করেন। কারণ, চীন যে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে, এটা তো দৃশ্যমান। এটা ঠিক, ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন ক্রয়ক্ষমতার বিচারে ভারতের মাথাপিছু আয় চীনের চেয়ে বেশি ছিল, কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এসে চীন এ ক্ষেত্রে তো বটেই, আরও বহুভাবে ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। ২০২২ সালে এসে দুই দেশের জনসংখ্যা প্রায় সমান হলেও চীনের অর্থনীতির আকার ভারতের প্রায় তিন গুণ হয়ে যায়।
সামরিক দিক থেকে ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধে চীন প্রমাণ করে দেয় যে তাদের শক্তি অনেক বেশি। এখনো তা-ই। এখন চীন যেখানে নিজেই নিজের অস্ত্র তৈরি করতে পারে, ভারতকে সেখানে রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। চীনের ‘একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্স’-এর সিনিয়র কর্নেল ঝাও শিয়াওজুর মতে, সমরাস্ত্রের দিক থেকে ভারত আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরেও চীনের সমকক্ষ হতে পারবে না।
যাহোক, চীন-ভারতের সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তিগুলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এবং সেটা এত দ্রুত পাল্টাচ্ছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একনায়কতান্ত্রিক এবং সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। যে সীমান্ত সংঘাতের কারণে দুটি দেশের সম্পর্ক দানা বাঁধতে পারছে না, সেই সংকট মেটাতে পারলে এই অঞ্চলে পশ্চিমের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসবে।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। ২০০৮ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সিভিল নিউক্লিয়ার কো-অপারেশন প্যাক্টে’ সই করেছে। ২০২০ সালের রক্তাক্ত সীমান্ত সংঘাতের পর ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ৭০ হাজার সেনা, ফাইটার জেট এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল চীনা সীমান্তে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে যৌথ সামরিক অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। নরেন্দ্র মোদি জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ড্রোন কেনা ও ভারতের মাটিতে যৌথভাবে ফাইটার জেট ইঞ্জিন তৈরি করার চুক্তিতে স্বাক্ষরও করে এসেছেন।
এত কিছু সত্ত্বেও সি চিন পিং সীমান্তে শান্তি চান এবং সম্ভবত মোদির ইচ্ছাও সেই রকম। মোদি তো জানেনই যে, সামরিক দিক থেকে তিনি চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তাই সীমান্ত নিয়ে দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে অন্তত ১৮ বার বৈঠক হওয়ার পর এখন সেখানকার অস্থিরতা অনেকটা থিতু হয়েছে।
আগে এই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন একটা ছিল না। কিন্তু ২০২০ সালে সেটা ৮৮ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এখানে চীনের পাল্লাটা ভারী, ভারতের চেয়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। ফলে চীন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। প্রযুক্তি, প্রপার্টি, অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতে চীনের বিনিয়োগ এখন বিশাল। অন্যদিকে চীনের অপো বা শাওমি মুঠোফোন এখন ভারতে খুব জনপ্রিয়। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতের পর ভারত চীনা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নানা রকম কড়াকড়ি আরোপ করলেও ২০২১ ও ২২ সালে তাদের আন্তবাণিজ্য ৪৩ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। ভারতীয় সরকারের নানা রকম বিধিনিষেধ এড়ানোর জন্য চীনারা এখন সিঙ্গাপুর হয়ে বা রিলায়েন্স গ্রুপের মতো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে ভারতে ব্যবসা করছেন।
তবে ভারতও এখন পশ্চিমের মতো চীন নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কথা হচ্ছে, ‘চাইনিজ দক্ষতা ভারতীয় প্রবৃদ্ধির ভিত্তি হতে পারে না।’ অথচ ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে আরও বহু বছর চীনের ওপর নির্ভর করতে হবে। যেমন ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে এখনো তাদের ৭০ শতাংশ উপাদানের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে চীনও একটু বেকায়দায় আছে। তার অর্থনীতি স্থবির হয়ে আসছে, জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং দিন দিন পশ্চিমের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। উল্টো দিকে এই তিন ক্ষেত্রেই ভারতের অবস্থা ভালো হচ্ছে। এ বছরই তাদের জনসংখ্যা চীনের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
এই দুই দেশের অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, বেইজিংভিত্তিক ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’, যার সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা হচ্ছে ভারত। এ ছাড়া ব্রিকসের কারণে ভারত তো এমনিতেই সাংহাইভিত্তিক ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর সঙ্গে যুক্ত।
যদিও এই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ উসকে দেওয়ার প্রবণতা আছে, ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে সমস্যা আছে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ভয় আছে এবং দালাই লামার জন্য একটা ভারতীয় অভয়ারণ্য বানিয়ে সেখানে তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার একটা বিষয় আছে, তারপরও তাদের কাছাকাছি আসার পক্ষে এক শ একটা যুক্তি হাজির করা যাবে। তাদের ব্যবসার প্রসার, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পশ্চিমা সমালোচনাকে উপেক্ষা করা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষ নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো শেষ অবধি তাদের পরস্পরের কাছে টানতে পারে।
এ কারণেই ২০১৪ সালে মোদি সি-কে তাঁর প্রদেশ গুজরাটে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং পরের বছর নিজে বেইজিংয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা একে অন্যের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারি।’
রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা বস্তুবাদকে পরিত্যাগ করে যন্ত্রের অন্ধকূপ থেকে যে আত্মাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এই দুই দেশকে এক হতে বলেছিলেন, সেই আত্মার মুক্তি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই; বরং সেই পশ্চিমা বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরার কারণেই অম্লত্ব কমে গিয়ে তাদের সম্পর্কটা ক্রমান্বয়ে মধুর হচ্ছে।
(দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ অবলম্বনে)
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক পিএসসি সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক