যে অদৃশ্য শক্তি বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যাকে সাধারণভাবে সিন্ডিকেট বলে অভিহিত করা হয়, তারা একটা খেল দেখিয়ে দিয়েছে গত সপ্তাহে। ৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা আগামী মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে কাজটি করে তারা। আর কে না জানে যে পেঁয়াজের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেওয়ারও নজির আছে।
যাহোক, সিন্ডিকেট সঙ্গে সঙ্গে এ সুযোগ গ্রহণ করে এবং এক রাতের মধ্যে প্রতি কিলোতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় ১০০ টাকা। বাড়তি দামে যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা আগেই আমদানি করা এবং ১০০ টাকা কম মূল্যে যখন বিকাচ্ছিল, তখনো তারা তা লাভেই বিক্রি করছিলেন। যদিও কয়েক দিনের ব্যবধানের পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে আসে।
বাংলাদেশে কমবেশি আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে। বর্ধিত দামে যদি তাঁরা এক লাখ টন পেঁয়াজও বেচতে পারেন, তাহলে ভোক্তাদের ট্যাঁক থেকে অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। তাঁদের জন্য এমন সুযোগ অবশ্য অহরহই আসে। কখনো চাল, কখনো আলু, কখনো ডিম, সৃজনশীলতার কোনো ঘাটতি নেই তাঁদের জাদুর বাক্সে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ ১৭ হাজার টন। পক্ষান্তরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারণি থেকে দেখা যায়, এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু পেঁয়াজের ব্যবহার ১৫ কিলোগ্রাম (ভারতে ১৬ কিলোগ্রাম)। সেই হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ২৫ লাখ টন পেঁয়াজই যথেষ্ট হওয়ার কথা। অথচ এরপরও সাত লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আমদানির তথ্যে তো কোনো ভুল নেই, তাহলে বাকি অঙ্কগুলোর কোনটাকে বিশ্বাস করব আমরা? নাকি সবটাই সেই ‘কাজির গরু’?
দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাপক মুদ্রা পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে দেশে, যা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সার কেনার যদি টাকা না থাকে, সে ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে, গম আমদানিও করা যাবে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে যদি কর্মসংস্থান না থাকে, আর প্রান্তিক মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।
পেঁয়াজের ব্যবহার নিয়ে আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু পেঁয়াজের ব্যবহার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। অর্থাৎ আগের তুলনায় আমরা এখন অনেক বেশি পেঁয়াজ খাচ্ছি। তাহলে তো এ কথা বলাই যায় যে বাজারের প্রয়োজনে আমরা খানিকটা পেঁয়াজ কম খেয়েও চলতে পারি, তাই না?
একটা কাজ করলে কেমন হয়? পেঁয়াজ আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হোক। দাম কিছুটা বেড়ে গেলে পরের বছর কৃষকেরা উৎসাহ পেয়ে একটু বেশি উৎপাদন করে বাজারে একধরনের ভারসাম্য নিয়ে আসবেন। আমাদেরও ভারত কখন নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হবে না। শুধু সিন্ডিকেটের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে সরকারকে, যা বলাবাহুল্য খুব সহজ নয়।
২.
জুলাই ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ ১৯ লাখ ৫৩ হাজার টন। ১৭ কোটি মানুষের দেশের জন্য পরিমাণটা বেশ কমই বলা যায়। সরকারি গুদামগুলোতে মজুত সক্ষমতাও মাত্র ২৩ লাখ টনের মতো। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অবশ্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সরকারি খাদ্যমজুতের পরিমাণ ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার টন (রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর, ১৬.১.২২)। ভারতের ১৪৩ কোটি লোকসংখ্যা মোটামুটি বাংলাদেশের সাড়ে আট গুণ। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মজুতের প্রয়োজন অন্তত ৪৫ লাখ টন। আরও কথা আছে। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ এবং দীর্ঘদিন ধরে সে দেশে কখনোই খাদ্যশস্যের জোগানের অভাব দেখা যায়নি। সরকারি গুদামে খাদ্য মজুত কম হলেও তাই ঝুঁকি নেই তেমন।
বিপরীতে পরিসংখ্যান যা–ই বলুক না কেন, বাংলাদেশকে নিয়মিতই খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারত যখনই মোটা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সিন্ডিকেট কাজে নেমে পড়ে এবং চালের দাম বাড়তে থাকে। সরকারের কাছে বড় মজুত থাকলে সময়মতো বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে এই কারসাজি থেকে, বিশেষ করে প্রান্তিক ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
বিভিন্ন সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জিকির শুনতে পাই আমরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২২-২৩ বছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার টন। ১২ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের দ্য ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত বিবিএসেএর তথ্যমতে দৈনিক মাথাপিছু চালের ব্যবহার ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। যদি তা–ই হয়, তবে ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে প্রয়োজন মাত্রই ২ কোটি ৪ লাখ টন চাল! অতিরিক্ত আরও ২ কোটি টন চাল তাহলে কোথায় যায়? আর ভারত মোটা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কি না, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হয় আমাদের? নাকি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিসংখ্যান সম্প্রসারণে মন দিয়েছে, সোভিয়েত আমলের মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর মতো?
৩.
৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে খবর দেখলাম, কোটালীপাড়ায় দলীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মার্চ মাসে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বিরোধী পক্ষ এই দুর্ভিক্ষ ঘটাবে এবং এতে বিদেশি প্ররোচনাও থাকবে। সাধারণ দৃশ্যটিতে বর্তমানে প্রবল দুর্দশাগ্রস্ত বিরোধী দল কীভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে, তা আমরা বুঝতে পারি না। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তথ্য রয়েছে বলেই তাঁর এ আশঙ্কা।
চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য খানিকটা যদি অতিরঞ্জিতও হয়, তবু আগামী বছর দেশে প্রচুর চাল থাকার কথা। আর আগের মতো বিদেশি খাদ্যসহায়তার ওপরও এখন আর নির্ভরশীল নয় দেশ। গম অবশ্য আমাদের বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে গমের অভাব নেই, সমস্যা হতে পারে শুধু অর্থের। বাংলাদেশে সর্বশেষ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে খাবার রেশনিং করতে হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক চাষি আর খেতমজুরদের মধে৵ তীব্র আকার ধারণ করা দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বাজারে যে চাল মোটেও ছিল না তা কিন্তু নয়। মানুষের হাতে অর্থ ছিল না খাদ্য কেনার।
দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাপক মুদ্রা পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে দেশে, যা আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সার কেনার যদি টাকা না থাকে, সে ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে, গম আমদানিও করা যাবে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে যদি কর্মসংস্থান না থাকে, আর প্রান্তিক মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১৯ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ‘মধ্যম পর্যায়ের’। এই স্কোর ২০ পার হলেই তা ‘গুরুতর’ বিবেচিত হবে (গুদামে সাড়ে তিন কোটি টন শস্য নিয়ে ভারত আছে ‘গুরুতর’ পর্যায়ে)। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি আরও বিস্তারিত শ্রেণিবিন্যাস করেছে ক্ষুধার।
এই বিন্যাসে বাংলাদেশের ৭% বা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ক্ষুধার চতুর্থ ধাপ তীব্র ক্রমিক খাদ্য অনিরাপত্তায় (সিভিয়ার ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি) অবস্থান করছেন। আমরা জানি যে মূল্যস্ফীতির কারণে ‘নিম্নমধ্যবিত্ত’ শ্রেণির মানুষ ইতিমধ্যে গোত্রান্তরের বাস্তব হুমকিতে আছেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন–পরবর্তী পর্যায়ে কি আরও অবনতি হবে পরিস্থিতির? বাজারে খাদ্যপণ্য হয়তো থাকবে, কিন্তু পর্যাপ্ত খাদ্য কেনার অর্থ থাকবে কি মানুষের হাতে?
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব