২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সাইবার নিরাপত্তা আইন নতুন বোতলে পুরোনো মদ নয়তো?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। নতুন আইনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত ও উদ্বেগকে গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
ফাইল ছবি

দেশে–বিদেশে সমালোচনার পর মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাতিলের সিদ্ধান্ত এল। প্রশ্ন হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন বাতিল হতে যাচ্ছে? আইনটি খারাপ, তাই বাতিল হবে; নাকি আইনটিতে নানা রকম অসামঞ্জস্যের কারণে আইনটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারছে না? নাকি সমালোচনার কারণে আইনটি বদলে ফেলা হবে? সরকারের উচিত আইনটি বাতিল করার কারণ জনগণের কাছে সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার করে বলা।

সরকার জানিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে উদ্ধৃত করে লিখেছে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা নতুন আইনে থাকবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিএসএর ঠিক কতগুলো ধারা নতুন আইনে প্রতিফলিত হবে? আইসিটি আইনের বিলুপ্ত হওয়া সমালোচিত ৫৭ ধারা যেমন ডিএসএর বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকার অভিযোগ আছে, নতুন আইনের ক্ষেত্রেও কি এমনটা হবে? এমনটা যদি হয়, তাহলে নতুন আইনটি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে কি না, সে আশঙ্কা থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে বিষয়টা নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো কিছু হওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে নতুন যে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হবে, সেখানে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে না। আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তাই কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে আইন দ্বারা কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে তা সংবিধানের ২৬ ও ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে বাতিল হয়ে যেতে পারে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। নতুন আইনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত ও উদ্বেগকে গুরুত্ব দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আমার মনে হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিতে ‘আধেয় নিয়ন্ত্রণ’, ‘সাইবার অপরাধের শাস্তি’ ও ‘সাইবার নিরাপত্তা কৌশল’—এই তিন বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। উচিত ছিল এই তিন বিষয় নিয়ে তিনটি ভিন্ন আইন করা।
সেপ্টেম্বর মাসে যদি নতুন আইনটি সংসদে পাস করার লক্ষ্য থাকে, তাহলে কবে আইনটির খসড়া জনগণকে দেখানো হবে, কবে বিভিন্ন অংশীজন আইনটি নিয়ে মতামত দিতে পারবেন, কবে সেই মতামতের ভিত্তিতে নতুন প্রস্তাবিত আইনটিতে পরিবর্তন আনা হবে? তাই অংশীজনদের মতামত ও উদ্বেগগুলোকে পুরোপুরি সমাধান না করে নতুন আইনটি পাস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এমনও হতে পারে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির বিরুদ্ধে যে সমালোচনাগুলো আছে, নতুন আইনটিতে সেগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা হলেও বলতে হয় যে সাধারণত প্রতিটি আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আলাদা থাকে। তাই নতুন আইনের খসড়াটি অংশীজনদের দ্বারা বিস্তারিতভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করেই নতুন আইন পাস করা উচিত।

আমি আশা করব, আইনটির শিরোনাম ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’–এর বদলে ‘সাইবার সুরক্ষা আইন’ করা হবে। আইনটি আমাদের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কৌশল ২০১৪, জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮, প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, প্রস্তাবিত ওটিটি নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, ব্লকচেইন, প্রাইভেসি বাই ডিজাইন ইত্যাদি নতুন প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট ধারা থাকবে। জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর), ক্রস বর্ডার প্রাইভেসি রেগুলেশন (সিবিপিআর), সাইবার ক্রাইম কনভেনশন ইত্যাদি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা বা মডেলগুলোর প্রতিফলনও থাকতে হবে নতুন আইনে। সর্বোপরি, নতুন আইনটিতে প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয়—রাষ্ট্রের এই দুই অংশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামো থাকতে হবে।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে নতুন যে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হবে, সেখানে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে না। আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তাই কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে আইন দ্বারা কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে তা সংবিধানের ২৬ ও ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে বাতিল হয়ে যেতে পারে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকা অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্ধৃত করে লিখেছে যে নতুন আইন হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চলমান মামলাগুলো বাতিল হবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা যে মামলাগুলোর বিরুদ্ধে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ আছে, সে মামলাগুলো নতুন আইনের সেভিংস ক্লজ দ্বারা যদি চলমান থাকে, তাহলে নতুন আইনটি নিয়েও সমালোচনা জারি থাকতে পারে।

মো. সাইমুম রেজা তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়