আনোয়ারুল খুন: নেপথ্যে শুধু সোনা চোরাচালান নাকি আরও কিছু

একজন সংসদ সদস্য মারা গেলে জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে তাঁর ওপর শোক প্রস্তাব নেওয়া আমাদের সংসদীয় রীতি। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঝিনাইদহ–৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত ১৩ মে কলকাতায় খুন হলেও তাঁকে নিয়ে কোনো শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়নি। কারণ, তিনি যে কলকাতায় খুন হয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার কোনো প্রমাণ এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি।

খুনিরা আনোয়ারুল আজীমকে খুন করে তাঁর লাশ টুকরা টুকরা করেছে, হাড় ও মাংস আলাদা করেছে, পরে বিভিন্ন স্থানে সেই টুকরা ফেলে দিয়েছে, যাতে তাঁর দেহাবশেষ কেউ খুঁজে না পান। যেই ভবনে আনোয়ারুল খুন হয়েছেন, সেই ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করা হয়। সেখানকার সিআইডি ওই টুকরাগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিল।

প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পচে যাওয়া ওই মাংসের টুকরাগুলো মানবদেহের। কিন্তু তা যে আনোয়ারুলের, এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব নেওয়ার আগে তিনি যে মারা গেছেন কিংবা খুন হয়েছেন, তার প্রামাণিক তথ্য থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রাথমিক তথ্য–প্রমাণের বরাতে জানানো হয়েছিল, সোনা চোরাচালান নিয়ে বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে আনোয়ারুল খুন হতে পারেন। আক্তারুজ্জামান তাঁর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। খুনের আগে তিনি কলকাতায় যান এবং ঢাকায় গুলশানে তাঁর বাড়িতে খুনিদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, আজীম খুন হওয়ার আগে সোনার চালান নিয়ে বিরোধের জের ধরে আরও দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ঝিনাইদহ অঞ্চলের অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘আক্তারুজ্জামানের চালান ধরা পড়ছিল বেশি।

এতে তাঁর লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৭ জানুয়ারি মহেশপুরে সাড়ে চার কেজি সোনার একটি চালান ধরিয়ে দেন। ওই চালান আনোয়ারুল আজীমের ছিল। এর জেরে আনোয়ারুলের সহযোগী তরিকুল ইসলাম (আকেলে) ওই দিনই মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা গ্রামে দুজনকে গুলি করে হত্যা করেন। এরপর তরিকুল ভারতে পালিয়ে যান। এ নিয়েও আক্তারুজ্জামান আরও ক্ষিপ্ত হন আনোয়ারুলের ওপর।’

আনোয়ারুল হত্যা নতুন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে, এ কথা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানই জানিয়েছেন। আনোয়ারুল খুনে সাইদুল কিংবা কামালের কী ধরনের সম্পৃক্ততা রয়েছে, এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। মরদেহটি শনাক্ত হলেই অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারব।’

দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বললেন, এখানে সোনা চোরাচালান ওপেন সিক্রেট। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সবাই ভাগ পান। আনোয়ারুল আজীম টোকেন সিস্টেম তৈরি করেছিলেন। টোকেন দেখালে পুলিশ–বিজিবি ধরবে না। জিজ্ঞেস করি, ওই অঞ্চলের সব এমপি–সাবেক এমপি কি এর বখরা পান? একজন বললেন, কেবল যশোর অঞ্চল নয়। খুলনা পর্যন্ত বখরা যায়।

আক্তারুজ্জামান ও আনোয়ারুল আবাল্য বন্ধু। আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলেও বেশির ভাগ সময় দেশে থাকতেন। বিদেশ থেকে সোনা এনে সড়কপথে ভারতে পাচার করতেন। গত এক বছরে তাঁর কয়েকটি চালান ধরা পড়লে তিনি এর পেছনে আনোয়ারুলের হাত আছে বলে সন্দেহ করেন।

আনোয়ারুলের খুনের পর তিনজন ঢাকায়, একজন ভারতে ও একজন নেপালে ধরা পড়েন। তাঁদের মধ্যে শিমুল ভূঁইয়ার জবানবন্দিতে ভয়ংকর সব চিত্র উঠে এসেছে। তাঁর জবানবন্দির ভিত্তিতে প্রথমে গ্রেপ্তার হন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবু। পরে তাঁর সূত্রে গ্রেপ্তার করা হয় ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র সাইদুল করিম ওরফে মিন্টুকে। তাঁদের দুজনকেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের এমপি হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগেরই দুজন প্রভাবশালী নেতা ধরা পড়লেন। তাঁরা ধরা পড়ার পর মামলা নতুন দিকে মোড় নেয়। ঝিনাইদহে আওয়ামী শিবির এখন দ্বিধাবিভক্ত। একপক্ষ খুনের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে। আরেক পক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিমের মুক্তির দাবিতে সরব।

সাইদুলের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন খুলনার চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া। তাঁর জবানবন্দিতে আনোয়ারুল হত্যার সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। জবানবন্দিতে শিমুল বলেছেন, আনোয়ারুলকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুলের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় গত ৫ অথবা ৬ মে। 

তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, আক্তারুজ্জামান সংসদ সদস্যকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকায় খুনি ভাড়া করেন। খুনের বিষয়ে মূল ভূমিকা রাখেন খুলনা অঞ্চলের একসময়ের চরমপন্থী নেতা শিমুল। তাঁর জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুলের নাম উঠে আসে। ১৪ জুন ডেইলি স্টার–এর শিরোনাম: ‘আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু খুনিদের অর্থ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।’ ৫ মে অথবা ৬ মে হোয়াটসঅ্যাপে আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে সাইদুলের কথোপকথনের সময় এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। 

ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ ওরফে বাবু স্বীকার করেন, আজীম খুন হওয়ার পর তিনি শিমুলের সঙ্গে দেখা করেন ও ফোনে টাকা দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। আক্তারুজ্জামান শিমুলের মাধ্যমে কামাল আহমদের কাছে এমপির হাত ও মুখে টেপ বাঁধা ছবি পাঠিয়েছেন। এই ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন

কামাল আহমদ আক্তারুজ্জামানের চাচাতো ভাই। তিনি বলেছেন, খুনের জন্য যেই অর্থ দেওয়ার কথা ছিল, তার একটি অংশ সাইদুলের কাছ থেকে নিয়ে ২৩ মে দেওয়ার কথা ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা জানিয়েছেন, সাইদুল আনোয়ারুলের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ভবিষ্যতে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে আগ্রহী।

তাহলে কি তিনি নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এমপি খুনে সহায়তা করেছেন? আক্তারুজ্জামান এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন।

শিমুলের ভাষ্য অনুযায়ী ৬ মে একজন বাংলাদেশি রাজনীতিকের দুই কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। ওই ২ কোটির মধ্যে ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল খুনিরা কলকাতা থেকে আসার পর। বাকি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ২৬ ও ২৯ মে।

শিমুল ভূঁইয়া যেই রাজনীতিকের কথা বলেছেন, তিনি কি সাইদুল করিম না অন্য কেউ? সাইদুল না হলে তৃতীয় কোনো নেতার আনোয়ারুলের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আনোয়ারুল হত্যা নতুন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে, এ কথা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানই জানিয়েছেন। আনোয়ারুল খুনে সাইদুল কিংবা কামালের কী ধরনের সম্পৃক্ততা রয়েছে, এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। মরদেহটি শনাক্ত হলেই অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারব।’

কিন্তু অনেক তদন্ত সত্যের কাছাকাছি এসেও থমকে যায়। এমপি আনোয়ারুল আজীমের বেলায়ও সেটি হবে না তো? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]