মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ঋণের জন্য কেন ডেটাভিত্তিক ক্রেডিট ব্যুরো জরুরি

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবা নিয়ে অনেক কাজ এবং অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস বা মোবাইল ব্যাংকিং অন্যতম। সারা দেশের শহরে এবং গ্রামে সব ধরনের মানুষের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, মাসে সাত কোটিরও বেশি অ্যাকাউন্ট সক্রিয় রয়েছে এবং দিনে ৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় অর্জন, সম্ভবত সবচেয়ে বড় অর্জন। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে এক নম্বর স্থান অর্জন করেছে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বদৌলতে মানুষ সহজে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছে। গ্রামেগঞ্জে-শহরে-বাজারে টাকা জমা দিতে পারছে, একজন আরেকজনকে টাকা পাঠাতে পারছে, এবং বিল দেয়া থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের মিনিট রিচার্জ বা ডেটা প্যাকেজ কেনার মতো কাজ সহজেই করতে পারছে। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা জাল বা সেফটি নেটের আর্থিক অনুদান সরকারি কোষাগার থেকে সরাসরি জনসাধারণের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে পোঁছে যাচ্ছে।

তবে ব্যক্তি পর্যায়ে লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অনেক প্রসার পেলেও, দেশের লেনদেনের একটি বড় খাত দোকানে কেনাকাটার জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। আশার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলা কিউআর কোড স্ট্যান্ডার্ড প্রবর্তন করেছে, যা রিটেল পেমেন্ট ডিজিটালাইজেশনে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে। এর ফলে একটি দোকানে শুধু একটিমাত্র কিউআর কোড থাকাই যথেষ্ট। দোকানের ক্রেতাসমগ্র বাংলাদেশের ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যে কোনো অ্যাপ থেকে এই কিউআর কোড স্ক্যান করতে পারবেন, এবং তাৎক্ষণিকভাবে লেনদেন করতে পারবেন। যেমন বিকাশের অ্যাপ ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংকের কিউআর কোডে পেমেন্ট করা যাবে এবং সোনালী ব্যাংকের অ্যাপ থেকে রকেট বা টালি’পে কিউআর কোডে পেমেন্ট করা যাবে।

ক্যাশ টাকার ব্যবহার কমিয়ে ডিজিটাল পেমেন্ট জনপ্রিয় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত মার্চ মাসে ঢাকাসহ আরো চারটি জেলায় একযোগে এই উদ্যোগ চালু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০টিরও বেশি ব্যাংক এবং বিকাশ-রকেটের মতো প্রধান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাংলা কিউআর সেবায় যুক্ত হয়েছে, এক লাখেরও বেশি দোকানে কিউআর কোড স্থাপন করা হয়েছে এবং সেবাদাতাদের গ্রাহক এবং দোকানদাররা কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই প্রতিদিন লেনদেন করতে পারছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে, ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ ভাগ লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে হবে।

ডিজিটাল পেমেন্ট সেবার পরবর্তী ধাপ হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সেবা হবে ডিজিটাল ঋণ বা ক্রেডিট সেবা। দেশের সবার জন্য ডিজিটাল ঋণ সেবা চালু হলে দেশের যে কোনো স্থান থেকে একজন মাইক্রো বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাঁর মুঠোফোন থেকেই ব্যবসায়িক ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ব্যাংক অ্যাপের মাধ্যমে আবেদনকারীর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবে, এবং বিগ ডেটা ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে আবেদনকারীর ঋণ ঝুঁকি নিরূপণ করবে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটের মধ্যে ঋণ অনুমোদন হবে। আবেদনকারী নিজের ফোন থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে ঋণের টাকা ব্যবহার করতে পারবেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা ক্ষুদ্র ঋণের জন্য অ্যান্ট ফিনান্সিয়ালের মাইব্যাংকের ৩-১-০ পদ্ধতির কথা বলতে পারি যেখানে তিন মিনিটে একজন গ্রাহক ঋণের জন্য আবেদন করেন, এক সেকেন্ডের মধ্যে আবেদন গৃহীত হয় এবং ঋণের টাকা একাউন্টে চলে যায়, শূন্য মানুষের ছোঁয়ায় সেবাটি চলে (ডেটা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এলগরিদম ব্যবহার করে)। এ পদ্ধতিতে তারা তিন বছরে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে।

ডিজিটাল ক্রেডিটের মাধ্যমে মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহজে, অল্প সময়ে, ও কম ঝামেলায়, ও সর্বোপরি, সাশ্রয়ী খরচে ঋণ সুবিধা দেয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে দেশের মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো শক্তিশালী হবে এবং দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। বাংলাদেশে এমএসএমই সেক্টরের অবদান জিডিপির ২৫ ভাগ হলেও, ভারতে তা ৩০ ভাগের বেশি এবং চীন, জাপান ও মালয়েশিয়ায় ৫০ ভাগেরও বেশি। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ক্রেডিট বাংলাদেশে এসএমই সেক্টরের অবদান বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আরেকটি যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৫২টি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। লক্ষ্যণীয় যে আবেদনকারীদের মধ্যে দেশের শীর্ষ মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, দেশের প্রযুক্তি খাতের বড় প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এবং সেই সাথে বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক সম্পৃক্ত রয়েছে। আমরা আশা করছি, ডিজিটাল ব্যাংক বাংলাদেশে মানসম্মত এবং পূর্ণাঙ্গ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ পূর্ণবয়স্ক মানুষ এবং শতকরা ৬০ ভাগ মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে। আশা করা যায়, ডিজিটাল ব্যাংক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ঘাটতি পূরণ করবে এবং আধুনিক মানসম্মত এবং পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সেবা স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারাদেশে পৌঁছে যাবে।

ধরে নিতে পারি ৫২টি ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স আবেদন করার জন্য অন্তত ১০০টি দল ডিজিটাল ব্যাংকিং বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে দেশের গণমাধ্যম, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অনেক আলোচনা এবং মতবিনিময় হচ্ছে। এর থেকে একটি বিষয়ে ঐকমত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান ব্যবসা হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছোট ছোট ঋণ দেওয়া, এবং ডিজিটাল ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার ক্রেডিট ডাটার উপযুক্ত অবকাঠামো এবং ব্যবহার।

দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করার জন্য ক্রেডিট ডেটা সংগ্রহ এবং ক্রেডিট স্কোরিং প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। লক্ষ্য করি, মোবাইল ব্যাংকিং চালু করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান একটা সফটওয়্যার সিস্টেম এবং সারাদেশে এজেন্ট নেটওয়ার্ক নিয়োগ করে কাজ শুরু করতে পারে, এবং আর্থিক দিক থেকে প্রিপেইড পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে এতে কোনো ঋণ ঝুঁকি থাকে না।

কিন্তু ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহকের সাথে বিনা সাক্ষাতে শুধুমাত্র মুঠোফোনে আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে, এর প্রতিকারে দেশে একটি সার্বজনীন ডেটা-ভিত্তিক ক্রেডিট রিপোর্ট এবং স্কোরিং প্ল্যাটফর্ম অপরিহার্য।

এমতাবস্থায় সার্থক ডিজিটাল ব্যাংকিং বাস্তবায়নের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে শুধুমাত্র মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ঋণের জন্য একটি ডাটা-ভিত্তিক সার্বজনীন ক্রেডিট ব্যুরো চালু করা যেতে পারে। এই অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্রেডিট ব্যুরো চালুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এই বিষয়ে কিছু প্রাথমিক ভাবনা এখানে দেয়া হলো:

  • সার্বজনীন ক্রেডিট ব্যুরো হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকা একটি পরীক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান এবং সেবা। ক্রেডিট ব্যুরো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে।

  • দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যাংক, এমএফআই, মোবাইল ব্যাংকিং এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক অংশীদার হবে।

  • দেশের সকল ব্যাংক, এনবিএফআই এবং মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান ঋণ দেবার আগে ব্যুরোর রিপোর্ট এবং স্কোরিং নেবে, এবং ঋণ প্রদান এবং নিয়মিত বা অনিয়মিত আদায়ের ঋণ তথ্য ব্যুরোকে পাঠাবে।

  • সিকিউরিটি অথেন্টিকেশন সাপেক্ষে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান বা নাগরিক তার ক্রেডিট রিপোর্ট এবং ক্রেডিট স্কোর অনলাইনে দেখতে পারবেন।

  • প্রয়োজনে ক্রেডিট ব্যুরো ডেটা-সমৃদ্ধ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সাথে ডাটা সহযোগিতার জন্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলবে (যেমন, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড, মোবাইল ফোন বা ই-কমার্স কোম্পানি)

  • প্রাথমিকভাবে মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ঋণের জন্য ক্রেডিট ব্যুরো ব্যবহার করা হবে (যেমন, এক কোটি টাকার নিচে ঋণের জন্য)

এই ধরনের একটি উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে ডেটা-ভিত্তিক ক্রেডিট ব্যুরো বাস্তবায়নের সুবিধা এবং সম্ভাব্যতা নিরূপনের জন্য একটি কমিটি করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে এই কমিটিতে এমআরএ ও আইসিটি ডিভিশনের প্রতিনিধিসহ নেতৃস্থানীয় ব্যাংক, এমএফআই, মোবাইল ব্যাংকিং এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা থাকতে পারেন।

ডেটা-ভিত্তিক ক্রেডিট ব্যুরো পৃথিবীতে নতুন কোন ধারণা নয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিশ্বে ১৫০ টিরও বেশি দেশে প্রাইভেট ক্রেডিট ব্যুরো সেবা চলমান রয়েছে। ভারতে ২০০৪ সাল থেকে এবং পাকিস্তানে ২০১৭ সাল থেকে এইরকম ক্রেডিট ব্যুরো চলছে। আমেরিকাতে ১৯৭৯ সালে ক্রেডিট স্কোরিং এর জন্য ফাইকো স্কোর চালু করা হয়েছে।

লক্ষ্য করা গেছে দশটি ব্যাংক একসাথে একটি ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। এছাড়াও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একটি মোবাইল অপারেটরের সাথে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ব্যাংক এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা করার প্রয়োজনীয়তা এবং মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, একটি সার্বজনীন ক্রেডিট ব্যুরো চালু করার ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার মনোভাব বিশেষভাবে কার্যকরী হবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত তা থেকে উপকৃত হচ্ছে। তেমনিভাবে বাংলা কিউআরভিত্তিক ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগ, দেশের ডিজিটাল লেনদেনকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। সর্বোপরি, ডিজিটাল ব্যাংকিং বাংলাদেশে সবার কাছে মানসম্মত এবং পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য সকল অংশীজনের সহযোগিতায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ডেটা-ভিত্তিক কার্যকরী ক্রেডিট ব্যুরো স্থাপন অত্যাবশ্যক। আমরা আশা করব সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্প সময়ের মধ্যে এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

  • ড. শাহাদাত খান একজন ফিনটেক উদ্যোগী প্রযুক্তিবিদ, ফিনটেক এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সম্পর্কিত বেসিস স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান, এবং টালিখাতার প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। ই-মেইল [email protected]