১০ বছর পর জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ভোট হচ্ছে। উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভূস্বর্গে খই ফোটা ফুটছে। তিন দফার ভোটের দুই দফাই ঝঞ্ঝাটহীন। ১ অক্টোবর তৃতীয় দফার ভোট। ৮ অক্টোবর ফল ঘোষণা। সে নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হবেই তো। একেক দলের ঝুঁকি ও বাজি একেক ধরনের। হার-জিতের ওপর অনেক কিছুই নির্ভরশীল।
দুই দফাতেই জম্মুতে ভোট পড়েছে উপত্যকার চেয়ে ঢের বেশি। যেমন জম্মুর পুঞ্চ, রাজৌরি, রেসাই জেলার ১১ আসনে ভোট পড়েছে গড়ে ৭৩ শতাংশ, সেখানে উপত্যকার শ্রীনগর, বদগাম ও গান্দারবলের ১৫ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৫১ শতাংশ! প্রথম দফার ভোটের ছবিও এমনই। দুই দফার এই ৫০ কেন্দ্রের মধ্যে শ্রীনগরের ৮ আসনে ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশের কম! ভোটের হারের এই বিস্তর ফারাকের অর্থ কী, তা নিয়ে ধন্দে পড়েছে সবাই। যে যার নিজের মতো করে অর্থ খুঁজছে, বিশ্লেষণ করছে; বুঝতে চাইছে—কেন শ্রীনগরের মানুষ ভোট নিয়ে এত উদাসীন।
এই খানাতল্লাশি বা বিশ্লেষণের একটা কারণ হতে পারে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদী হানা। কয়েক মাস ধরে বেশির ভাগ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ঘটছে জম্মুর কিশতোয়ার, রাজৌরি, পুঞ্চ, ডোডা এলাকায়। আক্রমণের লক্ষ্য অবশ্যই সেনাবাহিনী। অনেক দিন ধরেই সন্ত্রাসবাদীরা এমন কিছু করছে না, যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনজীবন ব্যাহত হয়, কারফিউ জারি হয়, অহেতুক সেনাতল্লাশি শুরু হয় বা পর্যটনে ঘা পড়ে।
সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগারের ওপর আঘাত জঙ্গিরা হানছে না। পরিযায়ী শ্রমিকদের আক্রমণের মতো ঘটনাও ইদানীং বন্ধ। জঙ্গিদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য সেনাবাহিনী। সেটাও প্রধানত জম্মু এলাকায়। হয়তো এ কারণে হিন্দুপ্রধান জম্মু দৃঢ়ভাবে মোদির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তেমনটা সত্যি হলে কংগ্রেস-এনসি জোটের পক্ষে সেটা হবে প্রবল ধাক্কা। মনে রাখা দরকার, লোকসভা ভোটে জম্মুর দুটি আসনই বিজেপি জিতেছিল।
এই পরিবর্তন জঙ্গিদের দিক থেকে কতটা কৌশলগত, কতটাই–বা সরকারের বজ্র আঁটুনির ফল, তা নিয়ে তর্ক থাকলেও এর একটা নতুন ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নাকি মন বদলেছে। ব্যাখ্যাটা নেহাত অযৌক্তিক নয়। ক্রমাগত দমন–পীড়নে হুরিয়ৎ কনফারেন্স দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। জামায়াতে ইসলামিও ‘অর্থহীন ভোট বয়কটের’ রাস্তা থেকে সরে এসেছে। সরকারও তাদের ভোটে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছে।
৩০ বছর পর জামায়াতে ইসলামি এই প্রথম ভোটে অংশ নিচ্ছে স্বতন্ত্র হিসেবে, সংগঠন যদিও নিষিদ্ধ। সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থানীয় লোকজনও নাকি বুঝছে, মূল স্রোতে ফেরত আসা জরুরি। মানসিকতার এই পরিবর্তনের প্রতিফলন ইভিএমে কীভাবে ঘটবে, কেউই সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত নন। আপাতত মাপকাঠি একটাই। গত লোকসভা ভোটে বারামুল্লা কেন্দ্রে স্বতন্ত্র ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার রশিদের জয় ও ওমর আবদুল্লাহর পরাজয়। জেলে থেকেও রশিদ জিতেছিলেন। ব্যবধান দুই লাখের বেশি!
এ কারণে মনে করা হচ্ছিল, এবার উপত্যকায় হইহই করে ভোট পড়বে। জম্মুর চেয়ে বেশি। অথচ হলো উল্টো। এই বিস্ময়ের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে ফল ঘোষণার পর।
জম্মুর ভোটে মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও কংগ্রেস জোটের। বাকিরা এলেবেলে। উপত্যকার লড়াই আবার বহুমুখী। এনসি-কংগ্রেস জোট ছাড়া রয়েছে পিডিপি। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক হলেও তারা আলাদা লড়ছে এনসির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়। লোকসভা ভোটে উপত্যকায় প্রার্থী না দিলেও বিধানসভা ভোটে বিজেপি লড়ছে ২০ আসনে। আর রয়েছেন অগুনতি জোরালো স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁদের কেউ জামায়াতের, কেউ ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির (এআইপি)। এ ছাড়া আছে বিজেপির মদদে জন্ম আলতাফ বুখারির আপনি পার্টি ও গুলাম নবী আজাদের আজাদ পার্টি। জোর প্রচার, তাঁদের মধ্যে যাঁরা জিতবেন, তাঁদের সমর্থন নিয়েই বিজেপি সরকার গড়ার চেষ্টা করবে। এ কারণে রশিদ, আজাদ, বুখারি ও জামায়াতকে বলা হচ্ছে ‘বিজেপির বি টিম’।
আবদুল্লাহ, গান্ধী ও মুফতি—এই তিন পরিবারকে মোদি চিহ্নিত করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের সর্বনাশের কারণ হিসেবে। এই তিন পরিবার তাঁর চোখে ভূস্বর্গের ভিলেন। তিন দল যদি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাদের ছাপিয়ে যদি বড় হয়ে ওঠে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি’ স্বতন্ত্রদের মাথা এবং তাদের যদি সরকারে শামিল করানো যায়, তাহলে মোদির হাত ধরে লেখা হবে উপত্যকার রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়। সেই অধ্যায় মোদির শ্লাঘার কারণ হলেও তার পরতে পরতে পোঁতা থাকবে নতুন শঙ্কার বীজ।
এই প্রচার যে ভিত্তিহীন, তা বুক ঠুকে কেউ বলতে পারছেন না। কারণ, আগের সব ভোটের তুলনায় এবারেরটা একেবারে আলাদা। এই প্রথম সেখানে ভোট হচ্ছে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর। বিজেপির কাছে সেই সিদ্ধান্ত ‘ঐতিহাসিক’। কেননা, এর ফলে জম্মু-কাশ্মীর অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে ‘একাত্ম’ হবে। তাদের দাবি, ভূস্বর্গের মানুষ ওই সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিয়েছে। উপদ্রবহীন শান্তিপূর্ণ উপত্যকা তার প্রমাণ। পাঁচ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীরকে তালুবন্দী রেখে বিজেপি স্বপ্ন দেখছে, ভোটে জিতে তারা সরকারই শুধু গড়বে না, প্রথমবারের মতো এক হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রী করবে।
এই স্বপ্ন সাকার করতে যা যা করা দরকার, যেমন রাজ্য দ্বিখণ্ডকরণ, নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোর পুনর্বিন্যাস, হিন্দু এলাকার আসন বৃদ্ধি—সব তারা করেছে। অধুনালুপ্ত এই রাজ্যের বিধানসভার আসন ছিল ৮৩। জম্মুতে ৩৭, কাশ্মীরে ৪৬। বিজেপি তা বাড়িয়ে করেছে ৯০। বাড়তি ৭ আসনের মধ্যে ৬টা বাড়িয়েছে জম্মুতে, উপত্যকায় ১টি। উপত্যকা ও জম্মুর মধ্যে আগে আসনের তফাত ছিল ৯টি। সেটা কমে হয়েছে ৪।
এসব রাজনৈতিক কারুকার্যের ফলে কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের ভোট হয়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীর নীতির অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় তিনি পাস করলেন না ফেল, তা ভোটের হার দিয়ে বোঝা যাবে না। উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভোট কতটা শান্তিপূর্ণ হলো, তা দিয়েও নয়। কাশ্মীর নীতির সাফল্য বোঝা যাবে উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে সাদরে বরণ করে নিচ্ছে কি না, তার মধ্য দিয়ে। সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ৪৬টি আসন বিজেপি একাই জিতল কি না, তা দিয়ে।
বিজেপি জানে সেটা অসম্ভব। কিন্তু সরকার গড়া সম্ভব। সেই কারণে তারা জম্মুর ৪৩ আসনের সিংহভাগ দখলে মরিয়া। ২০১৪ সালের ভোটে তারা জিতেছিল সবচেয়ে বেশি আসন—২৫টি। এবারও কমবেশি তেমন আসন জিতলে বাকি সমর্থনের জন্য তারা নির্ভর করবে উপত্যকার ওপর। ‘সন্ত্রাসবাদী’ ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে প্রচারের জন্য জামিন দেওয়া, জামায়াতে ইসলামির নেতাদের প্রার্থী করার কারণও তা।
আবদুল্লাহ, গান্ধী ও মুফতি—এই তিন পরিবারকে মোদি চিহ্নিত করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের সর্বনাশের কারণ হিসেবে। এই তিন পরিবার তাঁর চোখে ভূস্বর্গের ভিলেন। তিন দল যদি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাদের ছাপিয়ে যদি বড় হয়ে ওঠে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি’ স্বতন্ত্রদের মাথা এবং তাদের যদি সরকারে শামিল করানো যায়, তাহলে মোদির হাত ধরে লেখা হবে উপত্যকার রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়। সেই অধ্যায় মোদির শ্লাঘার কারণ হলেও তার পরতে পরতে পোঁতা থাকবে নতুন শঙ্কার বীজ।
কিন্তু সাত মণ তেল পুড়িয়েও রাধার নাচ যদি না দেখা যায়? সরকার গঠনের মতো অবস্থায় বিজেপি যদি না পৌঁছতে পারে? ভিলেনরা যদি ফের ভূস্বর্গের ক্ষমতায় বসে? তাহলে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পেতে জম্মু-কাশ্মীরকে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে। ভূস্বর্গ শাসিত হবে কেন্দ্র থেকে, যেমন হচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। যেমন হচ্ছে দিল্লিও। তখন এটাও বোঝা যাবে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ, ডিলিমিটেশন, মূল স্রোতে ফেরার নামে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ তোল্লা দেওয়া, একাত্মতার এত ঢক্কা নিনাদ—সবই ভস্মে ঘি ঢালার শামিল। নরেন্দ্র মোদিকেও তখন হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হতে হবে ঘরে ও বাইরে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি