বাংলাদেশের সঙ্গে এই মুহূর্তে ভারতের সম্পর্ক ঠিক স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আগস্ট মাসে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ভারতের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তারা কোনোভাবেই মানতে পারছে না।
সম্প্রতি বহিষ্কৃত ইসকন নেতা ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পর সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা হামলা করেছে। ভাঙচুর করেছে এবং আমাদের জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছে। এ ঘটনায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেছিল বাংলাদেশ সরকার।
স্বভাবতই ভারতীয় উগ্রপন্থীদের এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশিদের আহত করেছে। তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এর আগে কলকাতায় উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও হামলার চেষ্টা করেছিল একদল ভারতীয়। ওই ঘটনার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। যদিও আগরতলায় হামলার পর ভারত দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর ভারতের আচরণ কখনোই বন্ধুসুলভ মনে হয়নি। প্রতিবেশী হিসেবে ভারত একচেটিয়া আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এটা দেশের সাধারণ মানুষকে ক্রমেই ভারতবিরোধী করে তুলছে।
ভারতকে বুঝতে হবে যে জুলাই বিপ্লব কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল গণমানুষের আন্দোলন। আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামপন্থী, বামপন্থীদেরও অংশগ্রহণ থাকলেও এটি একটি গণচরিত্র ধারণ করেছিল এবং এই গণ–আন্দোলনের মুখেই স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়েছে। দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হলেও প্রথম দিকে ভারতবিরোধী তেমন কোনো প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পর ভারতীয়দের অনিয়ন্ত্রিত আচরণের প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
তবে শুরুটা হয়েছিল ভারতের দিক থেকেই। শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে নিরন্তর হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। একবার চট করে দেশে ঢোকার কথা বলেছেন, আবার তালিকা করে ধরে ধরে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কের সভায় ভিডিও ভাষণে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পরিকল্পনাতেই গণহত্যা হয়েছে। আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত এখন নির্বিঘ্নে শেখ হাসিনাকে এসব কথা বলতে দিয়ে এ দেশের মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলছে।
ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমাগত অপতথ্যও ছড়ানো হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ভারতীয় রাজনীতিবিদেরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা সময় এমন সব কথা বলছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। চিন্ময় আটক হওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভারতে কোনো মুসলিম ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা আটক হলে বাংলাদেশ বিবৃতি দেয় না। কূটনৈতিক রীতি অনুসারে দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। কিন্তু এসব বিষয়ে ভারতের সরকার ও রাজনীতিবিদেরা কূটনৈতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা করছেন না।
ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমাগত অপতথ্যও ছড়ানো হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ভারতীয় রাজনীতিবিদেরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা সময় এমন সব কথা বলছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। চিন্ময়ের আটক হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন। পেঁয়াজ, আলু পাঠানো বন্ধ করে দেবেন বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানোর মতো উদ্ভট কথাও বলেছেন।
ভারতের একশ্রেণির গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের আচরণে মনে হচ্ছে, তাঁরা রাগে ফুঁসছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করাই কি তাদের রাগের কারণ? হতে পারে শেখ হাসিনা ভারতকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এখন তিনি পালিয়ে যাওয়ায় ভারতের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের সংযত আচরণ করা উচিত।
চিন্ময় আটক হওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভারতে কোনো মুসলিম ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা আটক হলে বাংলাদেশ বিবৃতি দেয় না। কূটনৈতিক রীতি অনুসারে দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। কিন্তু এসব বিষয়ে ভারতের সরকার ও রাজনীতিবিদেরা কূটনৈতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা করছেন না।
এসব কারণেই মূলত বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত সরকারের প্রতি বিদ্বেষ বাড়ছে। এটা ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আচরণের কারণেই হচ্ছে। এখান থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশের মানুষকে আস্থায় নিতে হবে ভারতকে। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে হবে ভারতকে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিবেশী কোনো দেশেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতের প্রতি ভালো ধারণা নেই। নিরাপত্তার কারণেই প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারতের হাতে রাখা দরকার। এটা করতে গিয়ে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছে। নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করেছে। এটা টেকসই কূটনীতি নয়। একসময় না একসময় ভারতপন্থী সরকারগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। এর ফাঁকে জনসাধারণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
এসব ঘটনা থেকে ভারত শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং ভারতের রাজনীতিবিদেরা একের পর এক উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, ভারতের উসকানিতে কেউ পা দিচ্ছেন না। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পরবর্তী ঘটনায় সারা দেশের মানুষ নজিরবিহীন ঐক্য ও সংযম প্রদর্শন করেছে। সব ধর্ম ও জাতি মিলে শান্তি বজায় রেখেছে। আগরতলার ঘটনায় জনসাধারণ প্রতিবাদ করলেও উগ্র আচরণ করেনি।
নিরাপত্তার খাতিরেই ভারতকে উগ্রতা পরিহার করতে হবে এবং বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে হবে এই বলে যে তারা সৎ প্রতিবেশী হিসেবে অন্যদের ক্ষতির কারণ হবে না। ভারত যদি এ ধারণা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে তৈরি করতে পারে, তাহলে ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকি এমনিতেই কমে যাবে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে ভারত। সীমান্তে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে, উজানে নদীর পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে নিজের স্বার্থ আদায় করতে চেয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু ভারত যদি সীমান্তে হত্যা বন্ধ করে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে নদীর পানি বণ্টন করে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলেই ভারতবিরোধী মনোভাব এমনিতেই কমে আসবে এবং নিরাপত্তাঝুঁকিও কমবে।
নিরাপত্তাসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশকে ভারতের প্রয়োজন। আবার ভারতকেও বাংলাদেশের প্রয়োজন। তাই আস্থার সম্পর্ক বজায় থাকলে উভয় দেশই লাভবান হবে। কিন্তু ভারত চাপ দিয়ে একচেটিয়াভাবে স্বার্থ আদায় করতে চাইলে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকি যেমন বাড়বে, ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকিও বাড়বে। মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই দেশের সাধারণ মানুষ।
● ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক