ইউক্রেন এক হাজারের বেশি দিন ধরে যুদ্ধ দেখে এলেও গত মাসটা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। রাশিয়া উত্তর কোরিয়া ও ইয়েমেন থেকে ১১ হাজারের বেশি ভাড়াটে সেনা সংগ্রহ করেছে ইউক্রেনকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য।
রাশিয়া নতুন হিংস্রতায় ইউক্রেনের জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। শীত মৌসুমে ইউক্রেনীয়দের ঠান্ডায় মেরে ফেলতে চায় তারা। ইউক্রেনে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনের ভূমি দখল তারা অব্যাহত রেখেছে। দুর্ভাগ্যের গল্পের এখানেই শেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন এমন একজন, যিনি রাশিয়াকে পছন্দ করেন এবং ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই সবকিছুর পরও গত সপ্তাহজুড়ে যে প্রশ্নটি বারবার করে উত্থাপিত হচ্ছে, সেটি হলো, ‘পশ্চিমা বিশ্ব কি যুদ্ধকে নতুন করে উসকে দিচ্ছে না?’ পশ্চিমাদের অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে আক্রমণ চালানোর ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ ছিল, সেটা তুলে নেওয়ার পরই প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা যে নীতি নিয়েছে, সেটা অবশ্যই উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়ানোর নীতি নয়। এই নীতিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ইনক্রিমেন্টালিজম বা বৃদ্ধিবাদ শব্দ দিয়ে। এর অর্থ হলো কারও জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেমন ফোঁটায় ফোঁটায় খাবার দেওয়া হয়, ঠিক সে রকমভাবে ইউক্রেনকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে অল্প অল্প করে অস্ত্র সরবরাহ করে। ইউক্রেনকে এমন অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে না, যাতে করে তারা রাশিয়াকে তাদের ভূমি থেকে বের করে দিতে পারে। পশ্চিমারা দুটি কারণে ইউক্রেনকে এই সুযোগ দিচ্ছে না।
প্রথমত, এতে আরও অনেক বেশি ব্যয় বাড়বে। প্রতিরক্ষা, অস্ত্র সরবরাহ এবং ইউক্রেনের অর্থনীতি ও সমাজকে সচল রাখার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এমনিতেই যুদ্ধ খুব ব্যয়বহুল। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের ব্যয়ের কারণে ভোটাররা তাঁদের প্রতি বিমুখ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা সেটা দেখলাম। ভোটারদের ওপর বাড়তি করের বোঝা এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের থেকে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেন।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে যা যা প্রয়োজন, তার সবটা দিচ্ছে না, তার কারণ হলো এতে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, তার অভিঘাত তাদের গায়ে গিয়েও লাগবে। রাশিয়ার দিক থেকে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য যত ধরনের উসকানি (সম্প্রতি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা) থাকুক না কেন যুক্তরাষ্ট্র তাতে প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না। রাশিয়া যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে, বাইডেন প্রশাসন স্পষ্টই তার দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে এবং তারা তাদের পরমাণুসংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করেছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের আগে যদি ইউক্রেনকে আধুনিক অস্ত্রগুলো দেওয়া হতো কিংবা অস্ত্রগুলো দেওয়ার পরপরই তাদেরকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধে এখন ইউক্রেন ভালো অবস্থানে থাকত।
যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে পারে, ইউক্রেন কি রাশিয়াকে তাদের ভূখণ্ড থেকে বের করে দিতে পারবে? এর পাল্টায় আরেকজন বলতে পারেন, ইউক্রেনের হাতে যদি আরও আধুনিক অস্ত্র থাকত তাহলে কি রাশিয়া আগ্রাসন চালাতে সাহস পেত। যাহোক, লড়াইটা যদি ন্যায্য হতো তাহলে এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের প্রাণহানি আরও অনেক কম হতো।
ইউক্রেনীয়দের প্রাণহানির প্রথম ও সর্বপ্রথম দায় রাশিয়ার। কিন্তু কিছু দায় তো পশ্চিমাদেরও আছে। কারণ, তারা চাইলেই এর অনেকটাই থামিয়ে দিতে পারত।
বারবার করে শোনা যাচ্ছে ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিততে পারবে না (কিছু ক্ষেত্রে জেতা উচিত নয়)। অবশ্যই কিয়ার স্টারমার, ওলাফ শলৎজ ও জো বাইডেন এ ধরনের কথা বলেননি। বিষয়টি হলো, ইউক্রেনের হাতে যদি বিজয়ের জন্য হাতিয়ার দেওয়া না হয়, তাহলে তারা জিতবে কীভাবে।
সার্বভৌম ও অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে ‘ফোঁটায় ফোঁটায়’ অস্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার নীতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
রাশিয়ার জব্দ করা ৩০০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ইউক্রেনকে ব্যবহার করতে দিতে হবে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা (বিশেষ করে ছদ্মবেশী যেসব জাহাজে রাশিয়ার তেল পরিবহন করে) জোরদার করতে হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাতে হবে (বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা)। ইউরোপের যে দেশগুলোর অস্ত্র কারখানাগুলো থেকে ইউক্রেনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়, সেগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারে যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে, সেটা তুলে নিতে হবে। ইসরায়েলকে যেভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়, সেভাবে রাশিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে হবে। পশ্চিম ও পূর্ব ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা নিয়োগ করতে হবে। ইউক্রেনকে কীভাবে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে, সেই পথনকশা ঠিক করতে হবে।
পশ্চিমারা যা যা করার দরকার, তার সবটা কেন করছে না, তার পেছনে আরেকটি কারণ আছে। ঘটনাটি যদি পর্তুগাল বা ফ্রান্সে ঘটত, তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হতো। ইউক্রেনকে ‘ইউরোপের’ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। সে কারণে তাদের সহজেই উপেক্ষা করা হচ্ছে।
ইউক্রেন ফ্রন্টলাইন বা সম্মুখভাগের দেশ। একসময়কার ক্রেমলিন সাম্রাজ্যের অংশ মলদোভাও এখন রাশিয়ার প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিশ্চিত করেই দেশটি বিপদের মধ্যে আছে। পোল্যান্ড এবং বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোও মস্কোর প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীন অবস্থান নেওয়ায় রাশিয়ার ‘শত্রুতে’ পরিণত হয়েছে।
আর কত দূর পানি গড়ালে পশ্চিমা বিশ্ব এই সিদ্ধান্ত নেবে, এবার যথেষ্ট হয়েছে, এই যুদ্ধে এবার জেতা দরকার।
জেমস নিক্সি চ্যাটাম হাউসের রাশিয়া-ইউরেশিয়া কর্মসূচির প্রধান
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত