রাজনীতিবিদদের পক্ষে মানুষের সঙ্গে চলা ও দেশসেবার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। যতই বিতর্ক থাকুক, ইদানীংকালের রাজনীতি যতই নষ্ট হোক, এ বক্তব্য মিথ্যে নয়।
বাংলাদেশের নন্দিত ও আলোচিত ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি, এ কথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি। তিনি অবশ্য সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেছেন। সে অর্থে এটা কতটা ‘রাজনীতিতে যোগ দেওয়া’, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
এত দিন ক্রিকেট-চর্চার পাশাপাশি ভেতরে-ভেতরে তিনি কতটা ‘রাজনীতি’ করেছেন, তা অবশ্য কেউ জানে না। অতিসম্প্রতি তাঁর একটি পুরোনো পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, কখনো রাজনীতি করবেন না। সেটা অবশ্য ২০১৩ সালের কথা। এটা নিয়ে এখন বিতর্ক করা মানে কুতর্ক করা। আমাদের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিশিষ্টজনেরা হরহামেশা এ রকম কথা বলে আবার ভুলে যান। তাই সাকিবের এই পুরোনো পোস্ট নিয়ে বিতর্ক করা অনর্থক।
শনিবার সাকিবের পক্ষে তিনটি আসন থেকে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের ঘটনার পর স্পষ্ট ধরে নেওয়া যায়, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হতে আগ্রহী।
যেকোনো কাজের একটি প্রক্রিয়া থাকে। প্রতীকী অর্থে যদি বলি, আগে জমি তৈরি করতে হয়। এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ। চারা গাছের বড় হওয়া, ঝড়ঝাপটা থেকে সামলে রাখা। এরপর গাছটিতে ফল ধরে এবং পাকলে সেই ফল খাওয়া হয়। সাধারণ বিচারে রাজনীতির প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই কাম্য।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান তা করলেন না। তিনি সরাসরি তৈরি থাকা ফলদ গাছ থেকে ফলটি পেড়ে খেতে চান। অথবা তিনি আশা করছেন, ফলটি তাঁর সামনে এসে হাজির হবে, তিনি কেবল কাঁটাচামচ দিয়ে মুখে পুরবেন।
সাকিব আমাদের অনেক তরুণ-তরুণীর আদর্শ। তাঁর জীবন, কর্ম তাঁরা অনুসরণ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে শিখতে চান। সাকিব ভালো উদাহরণ তৈরি করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এখানে উত্তম আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি।
তবে সব সময় যে একই প্রক্রিয়া মেনে রাজনীতি করতে হবে, তা নিশ্চয় নয়। উদ্দেশ্য যদি ভালো হয়, সৎ হয়, তাহলে সব ক্ষেত্রে, সব পরিস্থিতিতেই শুভকামনা জানানো যায়।
আর ক্রিকেট তারকা, চলচ্চিত্র তারকাদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া, সংসদ সদস্য হওয়ার চেষ্টার মধ্যে কোনো কসুর নেই। আমাদের পাশের দেশ ভারতে ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ক্রিকেট তারকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মডেল—কতজনই সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁরা কখনো কখনো বিতর্ক, আবার কখনো হাস্যরসও তৈরি করেছেন। অনেকেই আবার ভালো কাজ করছেন।
২.
সাকিব আল হাসানের সংসদ সদস্য হতে চাওয়ার বিষয়টি আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। এখন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার গোধূলিলগ্নে। তবু জনপ্রিয়তা যথেষ্ট রয়েছে তাঁর। জনপ্রিয়তা থাকতে থাকতে একটা পেশা থেকে আরেকটি পেশায় যাওয়া, সাকিবের মনে হয়তো এমন চিন্তা কাজ করেছে। তিনি খ্যাতি ও ক্ষমতার মধ্যেই থাকতে চেয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষই তো ক্ষমতার কাঙাল! সাকিব তাই নিশ্চিতভাবে কেবল রাজনীতি করতে চাননি, তিনি সরাসরি সংসদ সদস্যই হতে চেয়েছেন। রাজনীতি করতে চাইলে তিনি কোনো দলে যোগ দিয়ে কোনো একটি বিশেষ কাজের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করতে পারতেন। এমন কিছু করতে পারতেন, যাতে তরুণেরা যুক্ত হতে পারেন, স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু লক্ষ করুন, সাকিব এসবের কিছুই করেননি। তিনি মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন একটি নয়, তিনটি। যেকোনো একটি তিনি পাবেন বলে আত্মবিশ্বাসী তিনি।
পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, সাকিব আল হাসান অন্য কোনো দলে যোগও দেননি। ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন, যেখানে এবার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হলেই তাঁর সংসদ সদস্য হওয়া অনেকটা নিশ্চিত।
৩.
শনিবার সন্ধ্যা থেকেই ভাবছিলাম, সাকিব আল হাসানের সংসদ সদস্য হওয়া কতটা অত্যাবশ্যক। তাঁর দিক থেকে নিশ্চয়ই আবশ্যক। কিন্তু তাঁর ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষীরা কী ভাবছেন, তা তিনি আমলে নেবেন না? সাকিব কি পেশাদার খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকতে পারতেন না? তিনি কি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দলের কোচ হতে পারতেন? তাঁকে তো সেটা আরও বেশি মানাত বলে মনে করি।
কেবল বাংলাদেশ কেন, সাকিব চাইলে অন্য দেশের দলেরও কোচ হতে পারতেন। কারণ, তিনি যেমন ব্যাটসম্যান, তেমন বোলার। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার তিনি। তাঁর সেই সুযোগ ছিল।
বারবার মনে হচ্ছে, সাকিব কি কোচ হিসেবে বাংলাদেশের রাহুল দ্রাবিড় হতে পারতেন? নিশ্চয় পারতেন। তা না করে সংসদ সদস্যর মতো অপরিচিত ভিন্ন এক পেশায় যেতে চাচ্ছেন তিনি। তাঁকে সেই পথে শুভকামনা জানিয়ে বলি, প্রিয় সাকিব, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য আপনাকে প্রয়োজন ছিল ও থাকবে।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]