অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে, এমন আশঙ্কা বেশ আগে থেকেই করা হচ্ছিল, অর্থনীতিবিদেরাও সতর্ক করছিলেন। দেশের অর্থনীতির গত তিন-চার মাস আগের অবস্থা বিবেচনায় নিলে বর্তমান পরিস্থিতি কি আরও খারাপ হয়েছে?
জাহিদ হোসেন: আগের চেয়ে যে ভালো হয়নি, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যেসব সূচক দিয়ে অর্থনীতির পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়, সেগুলোর কোনোটার অবস্থাই ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, রাজস্ব আয়, আর্থিক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ, ঋণাত্মক আমদানি, জিডিপি বা শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি—যেসব ক্ষেত্রে ডেটা পাওয়া যায়, সেগুলো বিবেচনায় নিলে বলা যায় পরিস্থিতি খারাপের দিকেই গেছে। শুধু এক ক্ষেত্রে স্বস্তি দেখা যায়, তা হচ্ছে রেমিট্যান্স। কয়েক মাস ধরে মাসে ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানির পরিসংখ্যান দেখলে অবশ্য মনে হয়, রপ্তানি খারাপ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিসংখ্যান ঠিক কি না। বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
তার মানে কি অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি? নাকি যথাসময়ে ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি?
জাহিদ হোসেন: আমি বলতে চাই যে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন কিছু নেওয়া হয়েছে, যেগুলোকে সঠিক বলে ধরে নেওয়া যায়। আবার কিছু ক্ষেত্র, যেমন বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর। এটা সুফল দেবে কি না বলা যাচ্ছে না। মুদ্রানীতি, বিনিময় হার—এসব ক্ষেত্রে নানা প্রতিশ্রুতি এবং অনেক কিছু করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সামনে বাজেটে এর কোনো প্রতিফল দেখা যায় কি না, সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এ সময় কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সক্রিয়তা দরকার ছিল, তা হয়নি। আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেনি বা নেয়নি। অথচ দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল। মূল কথা হচ্ছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যেসব উদ্যোগ ও নীতি নেওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।
পদক্ষেপ নেওয়া গেল না কেন? আপনি কী মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: সমস্যা সমাধানের যে পথ ধরা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ নয়। আবার সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা এসব না বুঝে করেছেন, এটাও আমি মনে করি না। একটি দৃষ্টান্ত দিই, সুদের হার ৯ শতাংশের যে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, তা এখন তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা আবার আগের নীতিতে ফিরে এসেছি। সুদের হার কম হলে ব্যবসা ভালো হবে, এটা আসলে ভুল ধারণা। কিন্তু কেন এটা করা হয়েছিল? বিশেষ স্বার্থে এবং বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছিল। সস্তায় ঋণ দিতে পারলে ক্ষমতায় থাকা যাবে, এটাই সম্ভবত বিবেচনা ছিল।
বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমরা সেই ভুল নীতি দেখি। পেঁয়াজ বা এ-জাতীয় কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আমরা বাজার কারসাজির কথা বলি। এ ক্ষেত্রে সরকার কী করে? খুচরা পর্যায়ে একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়। এ ব্যবস্থা কখনো কাজে দিতে পারে না। আমদানিকারক, আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর সরকার হাত দেয় না বা দিতে চায় না। আসল জায়গায় হাত না দিলে কাজ হবে কীভাবে?
আমরা দেখেছি, ডলারের দাম বেড়ে চলেছে। এখন সরকার ক্রলিং পেগ নীতি নিয়ে টাকার বড় অবমূল্যায়ন করেছে। অনেকে বলছেন, এটা আগেই করা উচিত ছিল। আপনার মন্তব্য কী? এখন নেওয়া ক্রলিং পেগ নীতি আদৌ কাজে দেবে কি?
জাহিদ হোসেন: ক্রলিং পেগ বলতে আমাদের এখানে যা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে, তা যদি সত্যিই ক্রলিং পেগ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে নড়াচড়ার জায়গা থাকা উচিত। এখানে আমরা দেখলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটা দাম ঠিক করে দিয়েছে। সেটা ১১৭ টাকা। এর ওপরে বা নিচে কতটা যাওয়া যাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে কিছু বলা হয়নি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি যে এই হেরফের ওপরে-নিচে এক টাকা হতে পারে। এখানে ডলার কেনার রেট, বেচার রেট—এসব ব্যাপার আছে। এগুলো পরিষ্কার নয়। আমরা ‘পেগ’ দেখতে পারছি ১১৭ নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু ‘ক্রলিং’ দেখতে পারছি না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১১৮ টাকার বেশি যদি আমরা ডলারের দাম দিতে না পারি, তাহলে কি আনুষ্ঠানিক পথে ডলার আসা কমে যাবে না? বাজার নিজেও মনে করে যে এই দাম নির্ধারণ টিকবে না। ফলে মুদ্রাবাজার ইতিমধ্যে অস্থির হয়ে পড়েছে। ডলারের দাম যেহেতু কমার সম্ভাবনা নেই, তাই যাঁরা রপ্তানি আয়ের বিল পাচ্ছেন, তাঁরা আরও দাম বাড়ার আশায় ডলার আনা পিছিয়ে দিতে পারেন।
নিকারাগুয়া ও ভিয়েতনামে এখন ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কার্যকর রয়েছে। নিকারাগুয়ার বাস্তবতা ভিন্ন। আর ভিয়েতনামে আগের দিনের বাজার বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন একটি রেট ঠিক করে দেয়। ওপর-নিচে এর ৫ শতাংশ কমবেশিতে কেনাবেচা করা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতির নামে যা কার্যকর করেছে, তাকে আইএমএফ স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার মনে হয়, তারা এমন কিছু জানে, যা আমরা জানি না। ডলার কেনাবেচার দামের সীমাটি হয়তো তাদের জানানো হয়েছে।
সুদহার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়াকে কীভাবে দেখছেন?
জাহিদ হোসেন: আমি মনে করি, দেরিতে হলেও এটা ভালো হয়েছে। সুদের হার কোথায় যাবে বা অনেক বেড়ে যাবে কি না, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ব্যাংক-কাস্টমার সম্পর্কের ভিত্তিতে এটা নির্ধারিত হবে এবং এটা নতুন কিছু নয়। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় না নিয়ে সুদের হার নির্দিষ্ট থাকলে বিকৃতি ঘটে। এখন সেটা সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে। যে ঋণে ঝুঁকি আছে, সেখানে সুদের হার বেশি হতে পারে; আবার যেখানে ঝুঁকি কম, সেখানে ব্যাংক কম সুদেও ঋণ দিতে পারে।
তবে অনেকে মনে করেন, সুদের হার উন্মুক্ত করে দেওয়ার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণগ্রহীতাদের জিম্মি করে ফেলতে পারে। আমি মনে করি, তেমন কিছু হবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না।
রিজার্ভের পতনও তো ঠেকানো যাচ্ছে না। এখন করণীয় কিছু আছে কি?
জাহিদ হোসেন: মুদ্রা বিনিময় হারও বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ব্যাংকগুলো প্রতিদিন কত দামে ডলার কিনবে ও কত দামে বিক্রি করবে, তা বিএবি ও বাফেদা মিলে ঠিক করতে পারে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কে কত দামে ডলার কিনবে ও বিক্রি করবে, তা যদি ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়, তবে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষের মধ্যেই প্রতিযোগিতা বাড়বে। যে সবচেয়ে বেশি দাম দেবে, তার কাছে ক্রেতা বিক্রি করবে, আর যে সবচেয়ে কম দামে দেবে, ক্রেতা তার কাছ থেকে কিনবে। এটা করা গেলে ডলার মজুতের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করি। ক্রেতা ও বিক্রেতারা আনুষ্ঠানিক বাজারের প্রতি আগ্রহী হবে।
ডলার-সংকটের কারণে বিদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লাভের অংশ নিতে পারছে না। বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু তাঁর দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ নিতে না পারার উদ্বেগ জানিয়েছেন। ডলার–সংকট বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে কি?
জাহিদ হোসেন: সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক। যারা বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে এ দেশে আসবে, তারা এতে আস্থা হারাচ্ছে। তারা দেখছে যে এখানে নীতির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বিশেষ জোন করছি, কিন্তু দেশে ম্যাক্রো ইকোনমি নিয়ে যদি তাদের সংশয় থাকে, তারা যদি মনে করে যে বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত নিতে পারবে না, তাহলে তারা এখানে বিনিয়োগ করবে কেন। তাদের কাছে তো বিনিয়োগের বিকল্প দেশ রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। সবাই এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারল; আমরা পারলাম না কেন? এমনকি দেউলিয়ার মুখে পড়া শ্রীলঙ্কা খুব দ্রুতই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে।
জাহিদ হোসেন: আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার অস্ত্রগুলো কী কী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আছে মুদ্রানীতি, সরকারের হাতে আছে ফিসক্যাল পলিসি বা রাজস্ব নীতি ও রেগুলেটরি কর্তৃত্ব। মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে আমরা উল্টো পথে হেঁটেছি। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় টাকা ছাপানো হয়েছে। সংকোচনের পথে না গিয়ে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। ডলার বাঁচানোর পথ হিসেবে অনেক পণ্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সবাই যখন সুদের হার বাড়িয়েছে, আমরা তখন কমিয়েছি। রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রের সাশ্রয়ের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এর সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বাজার ব্যবস্থাপনায় আমরা খুচরা পর্যায়ে দাম বেঁধে দিয়েছি, অথচ যাঁরা কারসাজি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিইনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অস্ত্রগুলো তো আমরা ব্যবহার করিনি।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে, তারা নানা শর্ত ও পরামর্শ নিয়ে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। তাদের এই যুক্ততা কী ফল দিচ্ছে?
জাহিদ হোসেন: আমাদের দেখতে হবে যে আইএমএফ যুক্ত হওয়ার আগে কী ছিল আর যুক্ত হওয়ার পর কী হয়েছে। এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় চলে গেছে। এখন পর্যন্ত এর কোনো ফলাফল আমরা দেখতে পাইনি। তারা অনেক নীতি পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলোর কিছু বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে সুদের হার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে (ইন্টারেস্ট করিডর পলিসি), টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি কার্যকর হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমল কি না, রিজার্ভ বাড়ল কি না। আমরা বলতে পারি যে কিছু কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু এর কোনো প্রভাব এখনো পড়েনি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে আইএমএফ যা পরামর্শ দেবে, তার সবই কাজের এমনও নয়।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, আইএমএফের শর্ত মেনে সরকার বিদ্যুৎ থেকে ভর্তুকি কমাচ্ছে; এতে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে থাকা জনগণের ওপর এটা আরও বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জাহিদ হোসেন: আইএমএফ বলেছে, ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশে সরকার বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করছে। এখন এই ভর্তুকি কমানোর দুটি পথ আছে, এক. বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়া; ২. সরকারের বিদ্যুৎ কেনার খরচ কমানো। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর সহজ পথ ধরেছে।
কিন্তু এই খাতের দুর্নীতি কমানো ও বেসরকারি উৎপাদকদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার অযৌক্তিক চুক্তি থেকে সরে আসার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কুইক রেন্টাল চুক্তির সময় শর্ত ছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে, কিন্তু সরকার তা নবায়ন করেই যাচ্ছে। সরকার তো ‘নো পাওয়ার নো পে’ নীতিতে যেতে পারে। সেটা করলে সরকারের অনেক অর্থ বেঁচে যায়। কিন্তু সেটা না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
লোড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও সরকার বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে অনেক অর্থ বাঁচাতে পারে। যে বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ দিতে পারে, তার কাছ থেকে আগে কেনা, তারপর চাহিদা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দামের ধাপ বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা; শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে, তখন কম দামে কম বিদ্যুৎ কেনা—লোড ব্যবস্থাপনার এসব পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সরকার অনেক অর্থ সাশ্রয় করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে যথাযথ লোড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারের পক্ষে প্রায় ১০০ কোটি ডলার সাশ্রয় সম্ভব।
ব্যাংক একীভূতকরণ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ তো ব্যর্থ হলো।
জাহিদ হোসেন: ব্যাংক খাতের সমস্যা দূর করতে সরকার ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ গ্রহণ করেছে। সেখানে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কথা ছিল, সেই ব্যাংকগুলোকে সুযোগ দেওয়া হবে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে। যদি তারা তা না পারে, তখন তাদের বিলোপ করা, অধিগ্রহণ করা বা অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা ২০২৫ সাল থেকে বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। কেন? এখন থেকে করতে অসুবিধা কী ছিল?
সেটা না করে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো কিছু ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ও খারাপ ব্যাংকগুলো একীভূত করার উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে একধরনের উদ্বেগ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ এখন চাপা পড়ে গেছে। পিসিএ অনুযায়ী এখন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে অন্তত একটি প্রক্রিয়া শুরু হতো। নীতির ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাবের কারণেই সেই পথ না ধরে ব্যাংক একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ডলারের দাম বাড়ার পর রপ্তানি খাতে প্রণোদনা বন্ধের কথা উঠেছে। আপনি কী মনে করেন?
জাহিদ হোসেন: ডলারের দাম না বাড়লেও আমি রপ্তানি খাতে প্রণোদনার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের পক্ষে। আমরা তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পে প্রণোদনা দিয়েছি। এর মূল লক্ষ্য ছিল রপ্তানি বহুমুখী করা। তাতে খুব কাজ হয়নি। তা ছাড়া এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ডব্লিউটিও মান অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে, তখন চাইলেও আমরা অনেক শিল্পকে প্রণোদনা দিতে পারব না। তাই আগেভাগেই প্রণোদনার বিষয়টি থেকে সরে আসার পথ ধরা উচিত। আর এখন তো প্রতি ডলারে ৮৪ টাকার জায়গায় পাচ্ছে ১১৭ টাকা। তাই প্রণোদনা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কোনো শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ নেই।
সামনে বাজেট। এমন একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেমন হওয়া উচিত এবারের বাজেট। আপনার কয়েকটি মূল পরামর্শ।
জাহিদ হোসেন: সামনের বাজেটের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ওপর আমি জোর দিতে চাই। প্রথমত, খরচ কমাতে হবে, অপচয় ব্যয় বাদ দিতে হবে, বিশেষ করে যানবাহন কেনা, ভবন বানানো ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে সংকোচন নীতি নিতে হবে এবং কোনোভাবেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ কমানো যাবে না, বরং বাড়াতে হবে। এই খাতগুলোর ব্যয়-সক্ষমতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু সেই যুক্তিতে বরাদ্দ কমানো যাবে না। কেন পারছে না, সেদিকে নজর দিতে হবে। প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রাজস্বের ক্ষেত্রে কিছু ভালো পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে। আমরা এ ব্যাপারে একমত যে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, তবে সেটা করহার বাড়িয়ে নয়। করের ক্ষেত্রে যে সুবিধা কার্যকর আছ, তা কমিয়ে ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টিকারী ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে। এ জন্য আয়করের ক্ষেত্রে শতভাগ সেলফ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে।
তৃতীয়ত, বাজেট ঘাটতি যতটা সম্ভব কম করা। ঘাটতি অর্থায়নের জন্য পাইপলাইনে থাকা ও ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুত ঋণ ও সহায়তার ওপর নির্ভর করা, কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য চেষ্টা করা এবং নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
জাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।