সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ করা কতটা যৌক্তিক

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য একজন আবেদনকারীর বয়স সর্বোচ্চ কত হতে পারে, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী এই বয়সসীমা ৩৫ বছর করার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। এর সূত্র ধরে বিষয়টি নিয়ে অনেকে পক্ষে-বিপক্ষে মত প্রকাশ করছেন এবং সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছেন। 

চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে যাঁদের বয়স একটু বেশি থাকে, তাঁরাই আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর আন্দোলন করে থাকেন। দুই দশক ধরে এ রকম আন্দোলন নিয়মিতভাবে সংবাদমাধ্যমে আসতে দেখা যায়। আন্দোলনকারীদের যুক্তি, বিভিন্ন দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত দেখা যায়। সুতরাং বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটরা কেন এই সুযোগ পাবেন না? তাঁদের মতে, বয়স নয়, যোগ্যতাই হতে পারে একজন প্রার্থী বাছাইয়ের প্রধান বিবেচ্য। তা ছাড়া মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও তাঁরা উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। এরপর ২০১১ সালে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরির বয়স বাড়ানোর কথা বলেছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় আন্দোলনকারী প্রার্থীরা আমরণ অনশনের মতো কর্মসূচি নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আসেনি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ২০১১ সালে ছিল ৭০ বছর। তা এখন বেড়ে ৭৪ বছরের কাছাকাছি হয়েছে। এই যুক্তিতে চাকরির অবসরের বয়সও নতুন করে বাড়াতে চান অনেকে। 

শিক্ষামন্ত্রীর বর্তমান সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসনমন্ত্রী জানিয়েছেন, আপাতত বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেই। তিনি আরও বলেছেন, ‘ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট’ যাঁরা, নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাঁর মতে, এখন ২২-২৩ বছর বয়স থেকে তরুণেরা বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারেন। ফলে অন্তত ছয়-সাত বছর সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ এখন একটি দারুণ সময় পার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স ২৭ বছর (গড় আয়ু নয়), ১৯৯০ সালে সেটি ছিল ১৭। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ এবং আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়সের গড় বেড়েছে বলা যায়। এই বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তরুণদের নিয়োগ পরীক্ষার মধ্যেই ব্যস্ত রাখা হলে এই সুযোগ আমরা হাতছাড়া করব। 

এই মাসের শুরুতে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে দেখানো হয়, সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষাগুলোয় চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্তদের বেশির ভাগের বয়সই কম।

৪১তম বিসিএসে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং ৪৩তম বিসিএসে প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রার্থীর বয়স ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে। অন্যদিকে বেশি বয়সী প্রার্থীর সফলতার হার অনেক কম। ৪১তম বিসিএসে ১৩ শতাংশ এবং ৪৩তম বিসিএসে ১৬ শতাংশের মতো প্রার্থীর বয়স ২৭ বছর বা তার চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২৯ বছরের বেশি বয়সী প্রার্থী মাত্র ১-২ শতাংশ।

জানিয়ে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ এখন একটি দারুণ সময় পার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স ২৭ বছর (গড় আয়ু নয়), ১৯৯০ সালে সেটি ছিল ১৭। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ এবং আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়সের গড় বেড়েছে বলা যায়। এই বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তরুণদের নিয়োগ পরীক্ষার মধ্যেই ব্যস্ত রাখা হলে এই সুযোগ আমরা হাতছাড়া করব। 

পৃথিবীর অনেক দেশেই বেশি বয়সে সরকারি চাকরির আবেদনের সুযোগ আছে, তবে সব ধরনের চাকরিতে নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার দরকার হয়। সেই দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া চাকরির আবেদনের বয়স যতই থাকুক না কেন, পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ অনির্দিষ্ট সংখ্যকবার থাকে না। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৫ বা ৭ বার সিভিল সার্ভিসের জন্য আবেদন করতে পারেন। আমাদের দেশেও যেকোনো যুক্তিতে বয়স বাড়াতে গেলে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত। 

আরও পড়ুন

যেসব প্রার্থীর বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই করছে, এমন চাকরিপ্রার্থীদেরও ভাবা দরকার, এখন লড়ছেন তিন-চার লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে। তখন সম্ভাব্য পাঁচ-ছয় লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়তে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পিএসসিকেও নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কেননা বিপুলসংখ্যক প্রতিযোগীর জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ও খাতা দেখার প্রক্রিয়া নিশ্চয় আগের মতো হবে না। এখন লিখিত খাতা মূল্যায়নে যত সময় লাগে, তখন এর দ্বিগুণ সময় লাগতে পারে। আর লিখিত পরীক্ষার জন্য আগের অনুপাতেই প্রার্থী বাছাই করা হলে একজন আবেদনকারীর সম্ভাবনা আগের চেয়ে প্রায় ৫০ ভাগ কমে যাবে। 

এর চেয়ে বরং দাবি ওঠানো যায়, প্রতিবছর বিসিএস নিয়মিত করা হোক। এতে ৩০ বছরের মধ্যে ৫-৭ বার পরীক্ষা দিয়েও যাঁদের সরকারি চাকরি হবে না, তাঁরা পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে নেওয়ার চিন্তা করতে পারবেন। তা ছাড়া আবেদনের বয়স ৩০ বছর মানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কিন্তু ৩০ থাকে না। কয়েক ধাপের পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশ, তথ্য যাচাই ও প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি শুরু করতে আরও দু-চার বছর লেগে যায়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বছর জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিতে ৫ লাখ ৪ হাজারের ওপরে শূন্য পদ রয়েছে। ২০২০ সালে এই শূন্য পদ ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার। তার মানে, চার বছরে শূন্য পদ বেড়েছে প্রায় ৬০ ভাগ। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করা গেলে শূন্য পদও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তরুণদের চাকরির সংকটের আরেকটি কারণ চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতার অভাব। ২০১৯ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, বিআইজিডি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা-জরিপ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছেন বাংলাদেশের তরুণেরা। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেও তাঁরা কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার চাকরির নিয়োগের সময়ে এই ব্যাপারটি দেখা যায়। তাই তরুণদের দক্ষ ও যোগ্য করে তোলার জন্য বাজারের চাহিদার দিকে নজর রেখে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যায়।

বিসিএস পরীক্ষার আরেকটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি হচ্ছে। সেটি পিএসসি যেন আমলেই নিচ্ছে না। চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন কেন মুখস্থনির্ভর হবে? তরুণেরা চাকরির পরীক্ষার উপযোগী হয়ে ওঠার জন্য বসে বসে কি শুধু তথ্য মুখস্থ করবে?  

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক