পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা সম্পর্কে সবার জানা। কিন্তু কোন ধরনের পর্যটন সম্ভাবনাকে টেকসই ও লাগসইভাবে কাজে লাগানো যাবে, সে সম্পর্কে কারও পরিষ্কার ধারণা নেই। এর ফলে এ পর্যন্ত পর্যটন–উন্নয়নে যা হচ্ছে, তা অপরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে। অনেকটা ‘অচেনা পথে চেনা গন্তব্যে চলার’ মতো চলছে। এ জন্য অচেনা পথের এই পর্যটন নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে, বিশেষ করে পাহাড়িদের বিরূপ ধারণা রয়েছে। তাঁদের মতে, পর্যটন মানে এখানে বহিরাগত লোকজনের ভূমিদখল ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পর্যটনবিশেষজ্ঞদের মতে, নেতিবাচক এই ধারণা কমিউনিটি টু্রিজম (সামাজিক পর্যটন) ও ইকোটুরিজমের (প্রতিবেশ পর্যটন) মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে। খুলে যেতে পারে পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনার দরজা। বাংলাদেশ টু্রিজম বোর্ডের (বিটিবি) পর্যটন মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ রকম মত দিয়ে থাকেন।
এক–দশমাংশ ভূখণ্ডে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, সবুজ বনভূমি ও জাতিগত বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার কারণে এখানে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখানকার পর্যটনশিল্পের উন্নয়নও ভিন্ন ধারায় হওয়া জরুরি। নয়তো বন, পাহাড় ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বিন্যাসের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পাহাড়ের মানুষও চান, তাঁদের জীবন-জীবিকাসহায়ক পর্যটন। রাঙামাটির সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুবর্ণ ত্রিপুরা বলেছেন, এই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সংরক্ষিত হবে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ থাকবে, এমন পর্যটন হলে অবশ্যই সবাই ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করবে। বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোও সম্ভব হবে। কিন্তু এ যাবৎ সে ধরনের পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো সুনিদি৴ষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া দালানকোঠা, হোটেল, মোটেল ও অবকাশযাপনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এ রকম অবস্থার কারণে পর্যটন বললে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন আতঙ্কবোধ করেন। এতে এ অঞ্চলের বিশাল পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
তবে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও রাঙামাটির সাজেক, বান্দরবানের বগা লেক, কেওক্রাডাং, রেমাক্রি, তিন্দু ও দেবতাখুমসহ বেশ কিছু এলাকায় সামাজিক পর্যটন গড়ে উঠছে। সেখানে স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে খুবই সাদামাটা পর্যটকসেবার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সাজেকের টুরিজম ভিলেজ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক পর্যটনের জায়গায় কোনো দালানকোঠা নেই। স্থানীয় গাছ ও বাঁশ দিয়ে নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আদলে খুঁটির ওপর মাচানের কটেজ নির্মাণ করে পর্যটকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক পর্যটন ও প্রতিবেশ পর্যটন কী
২০১০ সালের পর্যটন নীতিমালায় ইকোটুরিজম ও কমিউনিটি বেইজড টু্রিজমের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সমাজের লোকজন গৃহপরিবেশে পর্যটকসেবা প্রদানকে সামাজিক পর্যটন বলা হয়। অপরদিকে প্রাণ-প্রকৃতি ও সমাজ-সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিন্যাসকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে পর্যটনব্যবস্থা উন্নয়নই প্রতিবেশ পর্যটন। সামাজিক পর্যটনে স্থানীয় মানুষই উদ্যোক্তা অথবা অংশগ্রহণকারী। তাঁরা সেবা ও স্থানীয় পণ্য বিপণনে লাভবান হয়ে থাকেন। প্রতিবেশ পর্যটনও স্থানীয় উদ্যোগে হতে পারে। আবার স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বড় পরিসরেও হতে পারে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে পর্যটকদের ভ্রমণ চাহিদাও পরিবর্তিত হয়েছে। শহরের সাজানো-গোছানো কৃত্রিমতা ও বিলাসী দালানকোঠা নয়, পর্যটকেরা অকৃত্রিম প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চান। বান্দরবানের হোটেল-মোটেলের মালিকেরা বলেছেন, পর্যটকেরা এখন জেলা শহরে থাকেন না। তাঁরা বগা লেক, কেওক্রাডং পাহাড়, থানচির আমিয়াকুম–নাফাখুম, তিন্দু কিংবা দূরের কোথাও ছুটে যান। তাঁরা সেখানকার স্থানীয় মানুষদের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকেন। জেলা শহরের হোটেল-মোটেল খালি পড়ে থাকে।
সামাজিক পর্যটনের বর্তমান অবস্থা
ক্ষুদ্র পরিসরে রুমার বগা লেক, কেওক্রাডং পাহাড়ের দার্জিলিংপাড়া, রোয়াংছড়িতে লিরাগাঁইপাড়া, থানচিতে তিন্দু ও রেমাক্রিতে সামাজিক পর্যটন গড়ে উঠেছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরে স্থানীয় অধিবাসীরা এটি গড়ে তুলেছেন। সেখানে অনেকে নিজেদের পরিবারিক পরিমণ্ডলে পর্যটকদের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। কেউ কেউ কটেজ করেছেন। রুমায় ১ হাজার ৭৩ ফুট উঁচু পাহাড়চূড়ায় বগা লেকে বম জনগোষ্ঠীর বসবাস। সেখানকার সিয়াম কটেজের মালিক সিয়াম বম ১০ বছর ধরে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বম জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে খুঁটির ওপর মাচানের কটেজে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেবা দেবেন টাকা নেবেন’ এটিই পর্যটনের মূল কথা। পাড়ায় ৩২টি পরিবারের লোকজন যাঁদের পর্যটক রাখার সক্ষমতা নেই, তাঁরা দোকানে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে কোমরতাঁতের কাপড় বিক্রি করেন, খাবারের হোটেল চালান এবং অনেকে টুরিস্ট গাইডের কাজ করে থাকেন। এভাবে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটন মৌসুমে প্রতিটি পরিবার ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারে।
কেওক্রাডাং পাহাড়ে দার্জিলিংপাড়াটি টুরিজম ভিলেজ হয়ে উঠেছে। পাড়াবাসীরা বাড়িতে পর্যটক রাখেন। অনেকে আলাদা কটেজও করেছেন। পর্যটনের আয়ের পাশাপাশি ফলের বাগান ও আদা-হলুদের চাষ করেন। পাড়ার লালকীম বমের মতে, বিদেশি পর্যটকদের আনা গেলে তাঁদের আয় আরও বাড়ত। একইভাবে থানচির তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকুম, বড়মদকে, রোয়াংছড়ির দেবতাখুম ঘিরে লিরাগঁইপাড়ায়ও স্থানীয় অধিবাসীরা গৃহপরিবেশে পর্যটন পরিচালনা করেন।
ইকোটুরিজম
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে ইকোটু৵রিজমের আদলে পর্যটন গ্রাম করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে কংলাক রুইলুইপাড়ায় ১১০টি কটেজ করা হয়েছে। সেখানে কিছু ভবন রয়েছে বটে, তবে স্থানীয় সামাজিক ঐতিহ্য ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই অধিকাংশ কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে নন্দিত পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সাজেক অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর লক্ষাধিক পর্যটক সেখানে ভ্রমণ করেন।
পর্যটনশিল্পের ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশের মধ্যে নেপাল একটি। সেখানে অন্নপূর্ণা ও হিমালয়ের পাদদেশে গ্রামেগঞ্জে কমিউনিটি হোম-স্টে টু৵রিজম গড়ে উঠেছে। পর্যটকেরা গ্রামে পছন্দমতো যে কারও বাড়িতে অতিথি হতে পারেন। নেপালে কমিউনিটি হোম-স্টে নেটওয়ার্ক (সিএইচএন) নামে একটি ট্যুর অপারেটর সংস্থা রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পর্যটকেরা পছন্দমতো গ্রামে ভ্রমণে যেতে ও বাড়ি বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন। ভারতের নাগাল্যান্ডেও কমিউনিটি টু৵রিজম চালু রয়েছে। আমাদের দেশে সিলেটের কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরিদের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে ২০১৮ সাল থেকে কমিউনিটি টুরিজম চালু করা হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা ভিড় করেন বলে জানা যায়।
টুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) পর্যটন মহাপরিকল্পনার চলমান গবেষণায় এ পর্যন্ত ৩ পার্বত্য জেলায় ৮৫টি পর্যটন–আকর্ষণ স্থান শনাক্ত করা হয়েছে—রাঙামাটিতে ২৯টি, বান্দরবানে ৪১টি ও খাগড়াছড়িতে ১৫টি। শনাক্ত করা স্থানগুলোতে আট ধরনের পর্যটনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ৮৫টি স্থানের মধ্যে ৬০টি স্থানে সম্ভাবনা ইকো ও কমিউটি পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব। বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির মতে, কমিউনিটি টু৵রিজম এ অঞ্চলে পর্যটনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে এই খাতের উন্নয়নের উদ্যোগে পর্যটনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে।
বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি