ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স কি ১৭ হবে

বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স এক বছর কমিয়ে ১৭ নির্ধারণ করা উচিত বলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রস্তাব করেছেন ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক সম্মেলনে।

তিনি তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার করার পক্ষে। কারণ, যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি। তা ছাড়া তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের নিজস্ব মতামতকে জাতীয়ভাবেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তিনি আশা করেন, নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এ রকম একটা বয়স সুপারিশ করবে। তাঁর প্রস্তাব, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত। কিন্তু ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স পুনর্নির্ধারণের বিপুল আইনি এবং রাজনৈতিক তাত্পর্য রয়েছে। তাই আসুন, প্রথমেই প্রধান উপদেষ্টার মতামতের আইনি দিকটি দেখি। 

আমাদের শিশু আইন অনুযায়ী, ‘অনূর্ধ্ব–১৮ (আঠারো) বত্সর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।’ জাতিসংঘের মতে, যদি জাতীয় আইনে অন্য কিছু না থাকে, তাহলে ‘১৮ বছর বয়সের কম যেকোনো মানবসন্তানই শিশু’। আমাদের শিশুনীতি-২০১১ অনুযায়ী, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা কিশোর-কিশোরী গণ্য হবে।

দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এই শিশুরা যদি কোনো বিশেষ অপরাধেও জড়িত থাকে, তাহলে সেই সব অপরাধের অনুসন্ধান, তদন্ত আলাদাভাবে করার এবং বিচারকার্যও শিশু আদালতে করার বিধান রয়েছে। শিশুকালীন নির্ভরতা থেকে একজন স্বনির্ভর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হতে যে ক্রান্তিকালটা পার হতে হয়, সেই সময়ের নামই হলো কৈশোর। 

১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মানে হলো রাষ্ট্রীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে তারা যে মূল্যবান মতামত দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে, তার স্বীকৃতি দেওয়া। যদি ১৭ বছর বয়সেই এই সক্ষমতা অর্জিত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের ১৭ বছরের কিশোর-কিশোরীদের বিয়ের বন্দোবস্ত করাটাও তো বৈধ বলে ঘোষণা করতে হবে।

অথচ বর্তমানে বলবৎ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে বিবাহ, মানে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। এখন প্রশ্ন হলো, ১৮ বছর বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের বিদ্যমান অন্যান্য আইন সংশোধন না করে কি ভোটার হওয়ার বয়স পুনর্নির্ধারণ করা হবে?

এবার নজর ফেরানো যাক রাজনৈতিক দিকে। আমাদের জাতীয় তথ্যভান্ডার প্রতিদিনই হালনাগাদ হচ্ছে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন একটি সাংবাত্সরিক প্রক্রিয়া। ফলে এখানে জালিয়াতির সুযোগ কম। তবে নতুন যুক্ত হওয়া ১৭ বছর বয়সী ভোটাররা দেশের বিদ্যমান বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেবে না, এমন একটি হিসাব–নিকাশ থাকা স্বাভাবিক। 

ভোটারের বয়স কমানোর মতো ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন সংকট যেন তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি (এরই মধ্যে প্রশাসনিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে আমলাতন্ত্রে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে)। অন্যথায়, নির্বাচন ও সংস্কারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। ঘনীভূত হতে পারে রাজনৈতিক সংকট। 

ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ থেকে এক বছর কমিয়ে যদি কিশোরদের ভোটার করা হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে মোট কতজন নতুন ভোটার হতে পারবে। এ বিষয়ে সরাসরি কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।

তবে প্রতিবছর কতজন পরীক্ষার্থী এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়, এর থেকে আমরা একটি ধারণা পেতে পারি। যেমন ২০২৩ সালে ২০ লাখের অধিক পরীক্ষার্থী মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।

এর সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার আরও তিন লাখ শিক্ষার্থীকে যোগ করা যেতে পারে (কারণ, আমাদের মোট তরুণের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন কওমি ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করছে)।

আর এর সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের (যথাক্রমে ৩ ও ৩৪ শতাংশ) যোগ করলে সংখ্যাটা ৩২ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি, ভোটারদের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ করা হলে আগামী নির্বাচনে প্রায় ৩২ লাখ ভোটার বাড়বে। আমরা ধরে নিতে পারি, এই ভোটাররা আবার সারা দেশে সমভাবে ছড়িয়ে আছে। 

আমাদের মোট সংসদীয় আসন ৩০০। ৩২ লাখ নতুন ভোটার যদি দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকে, তাহলে প্রতি আসনে কিশোর ভোটারের সংখ্যা বাড়বে সাড়ে ১০ হাজারের কিছু বেশি। জাতীয় নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে এই কিশোর ভোটাররাই আগামী নির্বাচনে অন্যতম ফলনির্ধারক হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।

ভোটারের বয়স কমানোর মতো ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন সংকট যেন তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি (এরই মধ্যে প্রশাসনিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে আমলাতন্ত্রে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে)। অন্যথায়, নির্বাচন ও সংস্কারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। ঘনীভূত হতে পারে রাজনৈতিক সংকট। 

ড. মামুন আল মোস্তফা সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়