কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে যে দ্রুততায় সরকারবিরোধী প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক—প্রায় সর্বাত্মকও বটে—আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তা অবাক করেছে অনেককেই।
আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এর মাধ্যমে যেসব বার্তা এসেছে, সেগুলো চাপা দেওয়া যাবে না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া, বিশ্লেষণ করা। কাজটা জরুরি; কারণ, এ আন্দোলন আগাগোড়াই ছিল সরকারের বিরুদ্ধে এবং সত্য হলো, এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের পক্ষে সে কাজ করা সম্ভবই ছিল না। তবে সামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর ব্যাপক ভূমিকায় ও কারফিউ দিয়ে সরকার রক্ষা করা যায়, কিন্তু রাজনীতির ব্যর্থতা ঢাকা যায় না। আর সে জন্যই এ আন্দোলনের বার্তা বোঝা দরকার।
আমাদের সমাজের অবক্ষয় চলছিল অনেক কাল ধরেই। আওয়ামী লীগের এই একচ্ছত্র শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন দৃশ্যমান উন্নয়ন সত্ত্বেও সামাজিক এ অবক্ষয়কে গভীর করেছে। এ থেকে তরুণদের প্রাপ্তির কিছু ছিল না এবং তারা পায়ওনি। তারা কীভাবে বড় হচ্ছে, কী তাদের ভাবনা-দুর্ভাবনা এবং তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা কী, তার খবর নেওয়ার গরজও তেমনভাবে কেউ করেননি।
এরশাদ আমলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল গুছিয়ে নেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পরে তারা ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় অবস্থান স্পষ্ট করার বার্তাই গ্রহণ করেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল বুলি হিসেবে রেখে দলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিজীবনে ও রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয়কে দৃশ্যমান করেছেন। তাতে বাঙালি ও মুসলমানের মধ্যে অতীতে যে কৃত্রিম দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছিল, তা-ই প্রশ্রয় পায় এবং বাঙালি সত্তার (মুসলমান থেকেই) বিকাশ ব্যাহত হয়।
এভাবে সমাজ যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার দিকে ঘুরে গেল, তাকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল পাত্তাই দেয়নি; বরং ক্ষমতার কারণে ধর্মান্ধ দলকে তোষণের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
তাতে দেখা যাচ্ছে, একানব্বই-পরবর্তী তিন দশকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং ব্যক্তি হিসেবে তাদের নেতা-কর্মীদের দূরত্ব বেড়েছে প্রগতিশীল চিন্তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অংশের সঙ্গে। তারাই ১৪-দলীয় জোটকে কার্যত অকার্যকর করে রেখেছিল। তারপরও গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ দলটি সরকারের ভেতরে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনও এই রাজনীতির জনবিচ্ছিন্নতা বাড়িয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব আজ অবধি কেবল সব দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে চলেছে; তাদের মূল দাবি সম্পূর্ণ পূরণ ও অন্যান্য দাবি পূরণের প্রক্রিয়া চলমান ও সরকারের মন্ত্রী পর্যায় থেকে, এমনকি খোদ সরকারপ্রধানের আশ্বাসের পরও আন্দোলন প্রত্যাহার না করাকে ছাত্র আন্দোলনের স্বাভাবিক আচরণ বলে ভাবা যায় না। প্রশ্ন তোলা যায়, যে আন্দোলনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তা এতটা অর্জন সত্ত্বেও কার জন্য তারা চলমান রাখতে চায়? ফলে পরবর্তী প্রাণ ও সম্পদহানির দায় সরকারের সঙ্গে তারাও এড়াতে পারে না।
তাৎক্ষণিক লাভের জন্য ভ্রান্ত কৌশল গ্রহণ করলে তার মূল্য পরে হলেও দিতেই হয়। আমি আগেও লিখেছি, উন্নয়ন দিয়ে মানুষের অধিকার সংকোচনের প্রতিকার হয় না, বিশেষত ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ক্যাম্পাসে মুক্ত জীবনের ওপর আঘাত সংশ্লিষ্টরা গ্রহণ করে না।
বড় দলের ভুল নীতির ফলে এখন—এক. সমাজে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হয়েছে ও ধর্মান্ধ কট্টর পন্থার প্রভাব বেড়েছে; দুই. আওয়ামী লীগের (ও ছাত্রলীগের) ঐতিহ্যবাহী রাজনীতির এতটাই অবক্ষয় হয়েছে যে তা সমাজে কোনো রকম আদর্শিক প্রভাব ফেলার সামর্থ্য হারিয়েছে; তিন. একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দলকে সেনাসহ বিভিন্ন বাহিনী ও আমলাতন্ত্রনির্ভর হয়ে কঠোর দমননীতির মাধ্যমে সরকার চালাতে হচ্ছে; চার. ফলে দেশে এমন নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে ছাত্রদের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন থেকেও বৃহৎ গণ-আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সম্ভব। সরকারের জনপ্রিয়তা থাকলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রভাব বজায় ও সরকারি দলে তার চর্চা থাকলে বিরোধী রাজনীতিকে মাঠে মোকাবিলা করার মতো কার্যকর রাজনীতিচর্চা সম্ভব হতো। সে বাস্তবতা এখন নেই।
একটা মহল যে সরকারের মূল দুর্বলতা পর্যবেক্ষণে রেখেছিল এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারে উন্মুখ ছিল, তা এখন স্পষ্ট। কোটা সংস্কার আন্দোলন তাদের এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে মূলত ছাত্রদের আন্দোলন হলেও এর কারও কারও সঙ্গে যে সরকারবিরোধী বড় হামলার পরিকল্পনাকারীদের সংযোগ ছিল, তার কিছু আলামত পাওয়া যায়।
এটা ঠিক, আন্দোলনের ব্যাপারে সরকার প্রথম পর্যায়ে যথাযথ ভূমিকা না নিয়ে গা-জোয়ারি মনোভাব দেখিয়েছে। এতে সহজে সমাধানযোগ্য আন্দোলন বিশাল বিপর্যয় ডেকে এনেছে, দুই শতাধিক প্রাণ ও বিপুল সম্পদহানির কারণ হয়েছে। এ আন্দোলন দ্রুত ব্যাপকতা ও তীব্রতা লাভের দুটি প্রধান কারণ হতে পারে—এক. গত কয়েক বছরে সৃষ্ট প্রায় আট লাখ শিক্ষিত বেকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত ভবিষ্যতের কয়েক লাখ চাকরিপ্রত্যাশীর হতাশা ও ক্ষোভের সম্মিলিত বেগ-আবেগ যুক্ত হয়ে একে বড় রূপ দিয়েছে।
দুই. ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের এবং এলাকায় এলাকায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নানা স্তরের মানুষের দখলদারি-আধিপত্য, কর্তৃত্ব, দুর্নীতি এবং গা-জোয়ারি আচরণের প্রতিবাদ জানাতেও এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ ও মিছিল থেকে ভাঙচুরের ঘটনা যে মাত্রায় হওয়ার কথা, বাস্তবে হামলা ও ধ্বংসের বহর ছিল বিস্ময়করভাবে বেশি। পরিকল্পিত হামলায় অংশগ্রহণকারীদের সময়মতো সুনির্দিষ্ট ভূমিকা নিশ্চিত করা জরুরি। ফলে এই হামলাগুলো সম্পর্কে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেউই কিছু জানতেন না, তা হতে পারে না। একটা বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বড় হামলায় আড়াল প্রদানকারী আন্দোলনের নেতাদের কারও সঙ্গেই মূল পরিকল্পনাকারীদের কোনো যোগাযোগ না থাকা অবিশ্বাস্য।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করা যায়। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে সরকারের সমঝোতার মনোভাব এবং আন্দোলনরত ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে বসে সমাধানের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। নিশ্চয়ই এরপর আলোচনার জন্য অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগও হয়েছিল। স্বাভাবিক ছিল, তখনই আন্দোলনের লাগাম টেনে আলোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু তখনো জোর দেওয়া হলো আন্দোলনেই, যার ফল হয়েছে পরের তিন দিনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিপুল প্রাণ ও সম্পদহানি। দেখা যাচ্ছে, ১৯, ২০, ২১ তারিখের ধ্বংসযজ্ঞের সময় প্রাণহানিও বেশি হয়েছে এবং হতাহত মানুষের মধ্যে কিশোর-তরুণই ছিল বেশি। অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে তরুণদের অংশগ্রহণে বিরত থাকার সঠিক নির্দেশনা পায়নি অনেকেই।
আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্বও কম নয়। রাষ্ট্র বা জনগণের সম্পদ ও তাদের কর্মী কারও ক্ষতিই তো কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী, বিশেষত তাদের নেতৃত্বের, কাম্য হওয়ার কথা নয়।
এ সূত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, অবিভক্ত ভারতে ১৯২১ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা যখন একপর্যায়ে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, পাঞ্জাবের চৌরিচৌরায় থানা আক্রান্ত হয়, অস্ত্র লুট হয়, থানায় আগুন দেওয়া হয় ও আন্দোলনকারীদের হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন, তখন আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সরকারের কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়া একতরফাই অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন। এটাই হলো নেতৃত্বের দায়িত্বশীলতা।
কিন্তু আমরা দেখছি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব আজ অবধি কেবল সব দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে চলেছে; তাদের মূল দাবি সম্পূর্ণ পূরণ ও অন্যান্য দাবি পূরণের প্রক্রিয়া চলমান ও সরকারের মন্ত্রী পর্যায় থেকে, এমনকি খোদ সরকারপ্রধানের আশ্বাসের পরও আন্দোলন প্রত্যাহার না করাকে ছাত্র আন্দোলনের স্বাভাবিক আচরণ বলে ভাবা যায় না। প্রশ্ন তোলা যায়, যে আন্দোলনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তা এতটা অর্জন সত্ত্বেও কার জন্য তারা চলমান রাখতে চায়? ফলে পরবর্তী প্রাণ ও সম্পদহানির দায় সরকারের সঙ্গে তারাও এড়াতে পারে না।
যে কথা গোড়ায় বলেছি, সেই সূত্র ধরে বলব, মূলকথা হলো, দেশকে বিবদমান সংঘাতময় ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। কাজটা কঠিন হলেও এটা সময়ের দাবি, আজকের নেতৃত্বের জন্য অনিবার্য চ্যালেঞ্জ। তারা এবং নাগরিক সমাজ এযাবৎ ব্যর্থ হয়েছে। এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজকে ঘটনাপ্রবাহে ভেসে না গিয়ে বাস্তবতার আলোকে সবার কল্যাণচিন্তা মাথায় রেখে ভবিষ্যদ্দর্শী মানবিক উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে।
বলা বাহুল্য, সংকীর্ণ চিন্তা বাদ দিয়ে মহৎ ঔদার্যের পথেই এগোতে হবে। আমাদের ইতিহাসে তার সাক্ষ্য নেই, তা তো নয়। দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে প্রগতিচিন্তার রাজনীতির সংযোগ ঘটলে গণতন্ত্র ও দেশ—দুইয়েরই লাভ হয়। এর প্রমাণ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ অবধি বিস্তৃত। এটা ইতিহাসে আমাদের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দুঃখের বিষয় হলো, সেই গৌরব আমরা হারাতে বসেছি এবং দলীয় একাধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে দেশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক