দুই মাসে নদীর তালিকা করা কি সম্ভব?

একই নদী অনেক নামে থাকে। আবার একই নদী অনেক জেলার ওপর দিয়ে যায়।ছবি : প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি দেশের নদ-নদীর তালিকা দুই মাসে করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিআইডব্লিউটিএ, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং বিভাগীয় কমিশনারদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

অর্ধশতাধিক বছরে বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়নি। এর প্রধানত কারণ এ দেশে কখনো নদীবান্ধব সরকার ছিল না। দেশের জেলা প্রশাসকদের দেওয়া হয়েছে নদীর দায়িত্ব। তাঁরা কখনো আন্তরিকতার সঙ্গে নদী সুরক্ষায় কাজ করেন, এমনটা দেখিনি। বরং তাঁরাই আমাদের দেশের নদীগুলোর সর্বনাশের অন্যতম কারণ।

গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদ-নদীর তালিকা–সংবলিত বই প্রকাশ করেছে। তথ্য সংগ্রপূর্বক এই বই প্রকাশ করতে তারা সময় নিয়েছে প্রায় চার বছর।

বইটি ভুল তথ্যে ভরা। সেখানে নদীর প্রকৃত সংখ্যা একেবারেই নেই। বাস্তবে কি দেশের নদ-নদীর তালিকা দুই মাসে করা সম্ভব? সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তাহলে কি অযৌক্তিকভাবে দুই মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন? তিনি দীর্ঘকাল ধরে নদী-পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একজন পরিবেশকর্মী ও সংগঠক হিসেবে তিনি জানেন এ কাজ করা সম্ভব কি না।

নদীসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করতে দুই মাস সময় যথেষ্ট। এ জন্য সরল পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নদীর তালিকা প্রণয়নের জন্য বিভাগীয় কমিশনার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেবেন। জেলা প্রশাসক জেলার সব ইউএনওকে নির্দেশ দেবেন নদীর তালিকা প্রস্তুত করার জন্য। ইউএনও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেবেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। এই সংজ্ঞা অবশ্যই দেশের সব ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাতে হবে। নদীর সংজ্ঞা অনুযায়ী নদী এবং খালের মধ্যে অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। নদীকে কোথাও খাল, কোথাও ডারা, কোথাও খাঁড়ি হিসেবে ডাকা হয়। নদীর সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে, নদীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এগুলোকে নদীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উত্তরাঞ্চলে অনেক ছোট নদী আছে, যে নদীগুলোর প্রস্থের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্থের অনেক খাল আছে দক্ষিণাঞ্চলে।

আজ বিশ্ব নদী দিবস। উল্লিখিত বাস্তবতায় নদীবিমুখ প্রশাসনকে দিয়ে বাংলাদেশের নদীর তালিকা কীভাবে সম্পন্ন হবে, সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি। বিশ্ব নদী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, নির্ধারিত দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের নদ-নদীর পূর্ণ তালিকা আমরা পাব।

ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা দুভাবে নদীর তালিকা করবেন। সিএস ম্যাপভিত্তিক এবং সরেজমিন অনুসন্ধান সাপেক্ষে। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা প্রথমে সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) রেকর্ড অনুযায়ী মৌজা ম্যাপ নিয়ে কাজ করবেন।

মৌজা ম্যাপে যা নদী-খাল হিসেবে চিহ্নিত আছে, সেগুলোর হাত নকশা করবেন। এই কাজ করতে এক সপ্তাহের বেশি লাগবে না। এই কাজ শেষ হলে কর্মকর্তারা সরেজমিন অনুসন্ধান করবেন। তারা মূলত খুঁজে বের করবেন নদীর সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রাকৃতিক কোনো প্রবাহ আছে কি না। অনেক প্রাকৃতিক প্রবাহ আছে, যেগুলো নদী হিসেবে রেকর্ড হয়নি। এগুলোকেও তালিকাভুক্ত করতে হবে।

যখন নদীগুলোর সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হবে, তখন কোনটি সিএস রেকর্ডে খাল-খাঁড়ি-ডারা কিংবা অন্য নামে আছে, সেটি উল্লেখ করতে হবে। সিএস নকশার বাইরে যেগুলোর পাওয়া যাবে, সেগুলোকে নকশার বাইরে থাকা নদী হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। একটি উপজেলায় সব মৌজার সমন্বয় করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

একইভাবে জেলার সব উপজেলার সমন্বয় করবেন জেলা প্রশাসক কিংবা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। বিভাগীয় কমিশনার কিংবা অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সমন্বয় করবেন। কেন্দ্রের সমন্বয় করার দায়িত্ব পালন করবেন, যার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হবে তিনি।

একই নদী অনেক নামে থাকে। আবার একই নদী অনেক জেলার ওপর দিয়ে যায়। সেগুলো আমলে নিতে হবে। আন্তসীমান্ত নদীগুলোর সংখ্যাও চূড়ান্ত করতে হবে। সুন্দরবন এলাকার নদীর তালিকা করার সময়ে অবশ্যই যোগ্য-অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে করতে হবে।

নদীর সংখ্যা চূড়ান্ত করার কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন সব ইউয়িনে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা না–ও থাকতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে দিয়ে একাধিক ইউনিয়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এটি করা কঠিন হবে না। ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তিন-চারটি ইউনিয়নের কাজ করতে পারবেন।

নদীর সংখ্যা নির্ধারণের কাজটি অনেক সহজ হয়ে এসেছে। যাঁরা নদী নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাঁদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত নদীবিষয়ক বইগুলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যত দূর জানি, পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদ-নদীর হালনাগাদ অবস্থা নিয়ে একটি কাজ করছে। তারা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক সার্ভিস (সিইজিআইএস) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ কাজটি করছে। তারাও কাজটি যে ভালোভাবে করছে, এমনটি ভাবার কারণ নেই।

কয়েক মাস আগে রংপুরে বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে সিইজিআইএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তিরা একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলেন। সেই প্রেজেন্টেশন দেখে মনে হয়েছে তাঁদের কাজ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়েও দুর্বল। এরপরও তারা যে সংখ্যা চিহ্নিত করেছে, সেগুলোও দেখা যেতে পারে। রংপুর রাজশাহী বিভাগের নদীর তালিকা আমি এবং নদীগবেষক মাহবুব সিদ্দিকী সিইজিআইএসের কাছে দিয়েছি।

বাংলাদেশের নদীর মোট সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলায় একটি নদী আছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। স্থানভেদে এর নাম চাকিরশার, মরাতিস্তা এবং বুড়িতিস্তা। মধ্যবর্তী পাঁচটি মৌজা বিল শ্রেণিভুক্ত। এই মৌজার প্রায় আড়াই শ একর জমি অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি দখল করে নিয়েছেন। এটিকে মুক্ত করার জন্য আমরা প্রায় ছয় বছর ধরে একটানা আন্দোলন করে আসছি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে মামলাও করেছেন। উচ্চ আদালত নির্দেশনাও দিয়েছেন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন এই নির্দেশনা প্রতিপালন করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার পর তিনি চাকিরপশার উদ্ধারে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর প্রধানতম কারণ জেলা প্রশাসকদের কোথাও কোনো দিন কোনো জবাবদিহি করতে হয় না।

ফলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ডজনখানেক নির্দেশনা তারা উপেক্ষা করেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নিদের্শনা তারা আমলে নেয়নি। আদালতের নির্দেশনাকে গণনার মধ্যে রাখেনি। সেটি যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের আগেও, তেমনি পরেও।

নতুন জেলা প্রশাসক এসেছেন। নদী উদ্ধারে তিনি আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন। সময়ে বোঝা যাবে।

আজ বিশ্ব নদী দিবস। উল্লিখিত বাস্তবতায় নদীবিমুখ প্রশাসনকে দিয়ে বাংলাদেশের নদীর তালিকা কীভাবে সম্পন্ন হবে, সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি। বিশ্ব নদী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, নির্ধারিত দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের নদ-নদীর পূর্ণ তালিকা আমরা পাব।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক