২০ আগস্ট গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছেন দারিয়া দুগিনা। ‘ইউরেশিয়া’ (রাশিয়া, ইউরোপ ও এশিয়ার) মতাদর্শের তাত্ত্বিক গুরু আলেকসান্দর দুগিনের মেয়ে তিনি। ভ্লাদিমির পুতিনের ‘আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক’ ও ‘মস্তিষ্ক’ হিসেবে পরিচিত দুগিনের কন্যার ওপর এ হামলাকে পশ্চিমা গণমাধ্যম পুতিনের জমানার বিরুদ্ধে বড় একটা আঘাত বলে চিত্রায়িত করছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের এ অবস্থান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে পশ্চিমা নেতাদের বহুল নিন্দিত অবস্থানের প্রতিফলন। পশ্চিমা নেতারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুতিনের পতন হবে। কেননা রাশিয়ায় পুতিনের শাসনের বিরোধিতা বাড়ছে।
দারিয়া দুগিনা খুনের ঘটনায় ইংরেজি গণমাধ্যমের এ বানোয়াট অবস্থান মোটেই তথ্যনিষ্ঠ নয় কিংবা অনুমানভিত্তিক সাংবাদিকতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। যদিও এখন পর্যন্ত পাওয়া ভাসা ভাসা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ খুনের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এটা অনুমান করা যাচ্ছে যে দুগিনার খুনের পেছনে অবশ্যই ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আমরা যা জানতে পারছি:
ক. আলেকসান্দর দুগিন পুতিনের মিত্র নন; বরং পশ্চিমের প্রতি পুতিনের অবস্থানের একজন কঠোর সমালোচক।
খ. দুগিনা নন, দুগিনই ছিলেন এ খুনের লক্ষ্য। দুগিনার মন্দভাগ্য যে মস্কোয় একটি বক্তৃতা অনুষ্ঠান শেষে তিনি তাঁর বাবার গাড়িতে চড়ে ফিরছিলেন। ভিন্ন একটি গাড়িতে চড়েছিলেন দুগিন।
রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ সূত্রের ধারণা, এটি একটি অপেশাদার হামলা। কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কিংবা সাধারণ কোনো অপরাধী গোষ্ঠী এ হামলা করে থাকতে পারে। কেননা, রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ভালো করেই জানে, কীভাবে কাউকে নিকাশ করে ফেলতে হয় এবং খুব মসৃণভাবে তারা সেটা করতে সক্ষম। তাদের হাত থেকে শিকার ফসকে যেতে পারে না। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত একজন বিশ্লেষক বলছেন, ‘পুতিন যদি দুগিনকে হত্যা করতে চাইতেন, তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সেটা তিনি করতেন।’
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় আর বাকি থাকে বিদেশে অবস্থানরত রুশ অলিগার্কদের সঙ্গে সম্পর্কিত সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। বিদেশে অবস্থানরত অলিগার্কিরা দেশের ভেতরের অপরাধীদের দিয়ে আলেকসান্দর দুগিনকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছেন, সেই অনুমানই সবচেয়ে জোরালো বলে মনে হয়। সেই অলিগার্কিরা কোথায় বাস করছেন, কোথায় তাঁদের সম্পদের অবস্থান—এই প্রশ্নগুলো আলেকসান্দর দুগিনকে হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনার মূল সূত্র হতে পারে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, ইউক্রেন সরকার এ বোমা হামলার জন্য দায়ী। তবে এ দাবির সঙ্গে একমত হওয়া বেশ কঠিন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পুতিনের বিরোধীরা কি এ হত্যার সঙ্গে জড়িত? কিন্তু পুতিনের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠা একজন তাত্ত্বিককে হত্যা করার কোনো কারণ তাদের থাকতে পারে না। আবার কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, দুগিনকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে পুতিনের ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তুএ রকম একটি তালগোল পাকারো হামলার সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, এ হত্যার সঙ্গে কোনো অপরাধী গোষ্ঠী যদি যুক্ত থাকে, তাহলে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকেই হত্যার হুকুম আসতে পারে।
আমরা আবার বলছি, দুগিন পুতিনের বন্ধু নন। দুজনের মধ্যে অনেক অমিল আছে। ২০১৪ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে দুগিনকে অপসারণ করা হয়েছিল। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে পুতিনের সম্মতির প্রয়োজন। ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নামে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন করেছেন দুগিন। কিন্তু পুতিনের উপদেষ্টাদের কঠোর ভাষায় সমালোচনাও করেছেন তিনি।
দুগিনা হত্যার এক দিনমাত্র আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে সর্বশেষ পোস্ট দেন আলেকসান্দর দুগিন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, মস্কোতে একটা স্থিতিবস্থা চলছে। পুতিনের বর্তমান মন্ত্রিসভা ছয় মাসের বেশি টিকবে না এবং রাশিয়া একটা বিপর্যয়কর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগোবে। দুগিনের এ বিবৃতি বড় অর্থে পুতিনের শাসন পরিবর্তনের ডাক। দুগিন লেখেন, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান সবকিছুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এখন আর প্রশ্নটা সরকার পরিবর্তন করতে চায় কিংবা চায় না, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এমনকি কেউ যদি সেই পরিবর্তন আসাকে দেরি করানোর জন্য মরণপণ লড়াই শুরু করেন, তাহলেও সেটা ছয় মাসের বেশি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয় এবং তারপর তারা যেকোনোভাবেই হোক আসবে।’
দুগিন আরও লেখেন, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর মধ্য দিয়ে পুতিনের জমানার ইতিহাস নিজেই অনিবার্যভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। অস্তিত্ব–বিদ্যার ক্ষেত্রে নতুন একটি উপাদানের জন্ম হয়েছে, যেটাকে স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা ফরমান জারি করে বিলোপ করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের পরাক্রমী শক্তি রাজনীতির মাঠে খেলতে নামছে। টেকটোনিক প্লেটে (ভূত্বকীয় পাত) অদলবদল ঘটছে। পুরোনো জমানাকে নিজের কফিনটা সমাহিত করতে দাও। রাশিয়ার জন্য নতুন এক সময় আসন্ন। মার্জনাহীন এক সময়।’
একই দিনে ব্লগ পোস্টে দুগিন ঘোষণা দেন, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান দার্শনিক দিক থেকে সাম্রাজ্যের প্রত্যাবর্তন। এর অর্থ হলো, রাশিয়ার আবার সাম্রাজ্যের অধীন ফিরে যাওয়া।...যে ত্রাতাবাদী ভবিষ্যৎ আমাদের নিয়তি, এটা তারই পরিপূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা।...শেষ পর্যন্ত আমরা ইউরেশিয়া সাম্রাজ্যের কট্টর বার্তাবাহক।’
দুগিন তাঁর বক্তব্যে একটি ত্রাতাবাদী রাশিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। রোম ও বাইজেনটিয়ামের পতনের পর মস্কো তৃতীয় রোম হবে, এমনটাই তিনি মনে করেন। তাঁর কাছে মস্কো সভ্যতার শেষ দুর্গ।
দুগিনকে কারা আসলে হত্যা করতে চায়?
ক. পুতিনের আজ্ঞাবহ হয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী এ হামলা করেছে? যদিও পুতিন দুগিনকে অপছন্দ করেন, কিন্তু তাঁকে হত্যার মতো কোনো কারণ নেই। পুতিন যদি চাইতেন দুগিনকে হত্যা করতে, তাহলে কন্যা নয়, দুগিনকেই হত্যা করতেন।
খ. পুতিনকে বেকায়দায় ফেলতে রাশিয়ার বিরোধীপক্ষ কি এ হামলা করেছে? দুগিন পুতিনের জন্য বিরক্তির কারণ, এ ব্যাখ্যা তাদেরকে এ কাজে বাধা দেবে।
গ. এটি কি বিদেশি কোনো গোয়েন্দা সংস্থার হামলা? রাশিয়ার মাটিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন কিংবা ইউক্রেনের পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো অসম্ভব একটা ব্যাপার।
খুনের ধরন থেকে মনে হতে পারে, সম্ভাব্য দুই ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠী এতে জড়িত থাকতে পারে। এর আগে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মস্কোতে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এই গোষ্ঠী দুগিনকে লক্ষ্য করে হামলা চালাবে, সেটা ভাবা কষ্টকল্পনা। মার্কিন আধিপত্যের বিরোধিতার জন্য ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি দুগিনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। চেচনিয়ার মুসলমানদের প্রতি পুতিনের নিষ্ঠুর দমন–পীড়নের বিরোধিতা তিনি করেছিলেন।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় আর বাকি থাকে বিদেশে অবস্থানরত রুশ অলিগার্কদের সঙ্গে সম্পর্কিত সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। বিদেশে অবস্থানরত অলিগার্কিরা দেশের ভেতরের অপরাধীদের দিয়ে আলেকসান্দর দুগিনকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছেন, সেই অনুমানই সবচেয়ে জোরালো বলে মনে হয়। সেই অলিগার্কিরা কোথায় বাস করছেন, কোথায় তাঁদের সম্পদের অবস্থান—এই প্রশ্নগুলো আলেকসান্দর দুগিনকে হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনার মূল সূত্র হতে পারে।
ডেভিড পি গোল্ডম্যান আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ও লেখক
উবা পারপার্ট এশিয়া টাইমস অনলাইনের পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে