অতীতে ডিসিরা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পৃথক ব্যাংক, স্পেশাল ফোর্স, দিবস উদ্যাপনে কোটি টাকা বরাদ্দ, জ্বালানি তেল ব্যবহারের সীমা তুলে দেওয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বিচারিক ক্ষমতাও। এবার ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ডিসি সম্মেলনে তাঁরা চাইছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতি বন্ধ করতে। এবারও তাঁরা নাকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অন্তত ২৪৪টি প্রস্তাব তুলে ধরবেন!
বর্তমানে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিটিতে চেয়ারম্যান হন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। উপদেষ্টা হিসেবে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। শরীয়তপুরের ডিসি শিক্ষা কমিটিতে চেয়ারম্যানদের বদলে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ ইউনেসকো ও আইএলওর সদস্য। সেখানে শিক্ষকেরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারার কথা আছে।
২.
সংবিধান বলছে, নির্বাচিতদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘স্থানীয় শাসনের’ ভার থাকবে। উপজেলা পরিষদ বাতিলবিষয়ক কুদরত-ই-ইলাহি পনির মামলার ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছিল, জেলাসহ প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশ সব পরিস্থিতিতে শুধু নির্বাচিতরাই চালাবেন। প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ সৃষ্টির সময় আশঙ্কা করেছিলেন, আমলাতন্ত্র মাঠের নির্বাচিতদের গিলে খাবে।
এ দেশের জনগণ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি গণবিরোধী আমলাতান্ত্রিক আইনের বিরুদ্ধেই তো লড়েছেন। আর এর সাপেক্ষে যে আইন হবে, তা আমলাদের পক্ষেই যাবে। ফলে ডিসিরা প্রতিবার সম্মেলন করবেন আর ক্ষমতাকাঠামোতে গণবিরোধী কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে
এখন দেখছি, চেয়ারম্যানদের সরিয়ে ইউএনওদের শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান বানাতে চায়। অথচ আপিল বিভাগের রায় অনুসারে ইউএনও এবং ডিসির এসিআর লেখার কথা উপজেলা ও জেলা চেয়ারম্যানদের। কারণ, সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলছে, প্রতিটি জেলার ‘স্থানীয় শাসনে’ তিনটি বিষয় থাকবে। (ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা, (গ) জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। তিনি বলেছিলেন, ডিসিদের যেসব প্রস্তাব প্রতিবছর তুলে ধরা হয়, তার ৯০ ভাগ তোলারই এখতিয়ার তাদের নেই।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান ও ’৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়ও তারা বিচার বিভাগকে আলাদা করার বিরোধী ছিল। ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলার যে রায় এসেছিল, তা তাঁরা মানতে পারছেন না। হাইকোর্ট যে মোবাইল কোর্টকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন, তা–ও ঝুলে আছে।
গণপরিষদ সদস্য হিদায়েত-উল-ইসলাম বলেছিলেন, ‘ইংরেজ আমল এবং পরবর্তী সময় পাকিস্তান হওয়ার সময় থেকে দেখে আসছি যে জনগণকে শাসন করার জন্য...শাসকগোষ্ঠী একটি শাসনযন্ত্র কায়েম করেছিল। এবং সেই শাসনযন্ত্রে আমরা দেখেছি বিভিন্ন আইসিএস, বিসিএস...এই সমস্ত অফিসার সব সময়ই স্টিমরোলার চালিয়েছে জনগণের ওপর।...জনগণের দেওয়া টাকাপয়সায় তঁারা বাড়ি, গাড়ি এবং অনেক কিছু ভোগ করেছেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জনগণের উন্নতির জন্য সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে তাঁরা কোনো দিনই চেষ্টা করেন নাই।...সেই জন্য আজকে এই গণপরিষদ সদস্যগণ মনে করেছেন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে যদি প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভার থাকে এবং প্রশাসনব্যবস্থা যদি তাঁদের মাধ্যমে করা যায়, তাহলে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হবে, জনগণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং জনগণই যে এ দেশের মালিক, তা প্রতীয়মান হবে।’
৩.
আমাদের ডিসিরা তো ইউরোপ-আমেরিকা প্রায়ই প্রশিক্ষণে যান। সেখানে কি তঁারা ডিসিদের হাতে এত ক্ষমতা দেখেছেন? রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ও আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বলছেন, ৫৯(২) অনুচ্ছেদ পড়ার সময় ‘এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন’ বাক্যের অংশটুকুতে চোখ ফেললেই বুঝব কেন চেয়ারম্যান, মেয়ররা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হন। কোন আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট করবে?
সংবিধানের একাদশ ভাগের বিবিধ অধ্যায়ে ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “‘আইন” অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ এ দেশের জনগণ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি গণবিরোধী আমলাতান্ত্রিক আইনের বিরুদ্ধেই তো লড়েছেন। আর এর সাপেক্ষে যে আইন হবে, তা আমলাদের পক্ষেই যাবে। ফলে ডিসিরা প্রতিবার সম্মেলন করবেন আর ক্ষমতাকাঠামোতে গণবিরোধী কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক