অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি বিকাশের নতুন পথ

সংস্কৃতি বলতে সাধারণত আমাদের একটি ভাসা-ভাসা ধারণা রয়েছে। সংগীত, নৃত্য, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি শিল্পকলার কতগুলো কর্মকাণ্ডকে আমরা সংস্কৃতি বলে মনে করি।

এই ভ্রান্ত ধারণার মধ্যেই আমাদের সংকটের সূত্রপাত। সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সব আচার, যাপিত জীবনের উপকরণ, ভাষা, উৎপাদনব্যবস্থা, মানুষের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ব্যক্তি, পারিবারিক, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের গতিশীল অংশই সংস্কৃতি।

গাঙ্গেয় অববাহিকায় আমাদের এই ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষদের জীবনের ভিত্তিকাঠামো ছিল কৃষি, কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত উৎপাদনব্যবস্থা আর সহজ-সরল জীবনযাপন। নদীমাতৃক সমাজে নদীর প্রভাব ছিল বিস্তর।

চুলের বেণির মতো আঁকাবাঁকা নদীর জলের আঘাতে একদিকে পাড় ভাঙে তো অন্যদিকে জেগে ওঠে নতুন জমি।

নদীকে কেন্দ্র করে যাঁদের জীবিকা, তাঁরাই ছিলেন আমাদের পূর্বজ। বাঙালির জীবনের সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততার কারণেই সাহিত্য থেকে চিত্রপট কিংবা গান থেকে সিনেমা আবার উপন্যাস থেকে গল্প–কবিতায় আমরা নদীবেষ্টিত মানুষের জীবনধারণের বর্ণনা পাই।

আরও পড়ুন

সংস্কৃতির উপাদানের অংশ ছিল বনজঙ্গল। বনের প্রাণী শিকার অথবা খেয়ায় মৎস্য আহরণ জীবন ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। প্রভাব ফেলেছে ভাষায়।

জীবনাচারের সঙ্গে ধর্মীয় প্রভাব তখন তেমন লক্ষ করা যায়নি, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মানুষের জীবনে তার ধর্মীয় প্রভাব ও জীবনের অংশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

মধ্যযুগের বিভিন্ন সাধুসন্ন্যাসীর প্রচারে মানুষের জীবনে ধর্মীয় উৎসব বেশ বড় রকম প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।

আর্যদের আগমনের পর এই দেশের যারা ভূমিপুত্র ছিল, তারা ক্রমে আর্যদের কাছে পরাজিত হতে হতে একপর্যায়ে তাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মকেও হারিয়ে ফেলে এবং আর্যদের ভাষা, তথা জীবনাচারণের ধরন এবং ক্ষমতার প্রভাবে ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে।

ভূখণ্ডের আদিবাসীদের ওপর আর্যদের প্রভাব মোকাবিলার শক্তি আদিবাসী সংস্কৃতি, অস্ত্র, বল কিছুই ছিল না।

উৎপাদন, বাজার, অর্থব্যবস্থা সাংস্কৃতিক উপাদান, তথা রাষ্ট্র-উৎপাদিত বৈষম্যের মধ্য দিয়ে কোণঠাসা করে ভূমিপুত্রদের ক্রমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়।

আরও পড়ুন

অনেক পরে ষষ্ঠ শতকের পর পাল রাজাদের শাসনের সময় সনাতন ধর্মের যে বর্ণপ্রথা চরমে ওঠে, যা মূলত নিম্নবর্গের মানুষদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে হিন্দুধর্মের উচ্চবর্গীয়রা তাদের দলিত করে রাখত।

সে জন্য নিম্নবর্গীয় মানুষেরা দলে দলে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে এবং বৌদ্ধধর্মের এই সময়ে বাংলাদেশে (তৎকালীন ভারতবর্ষে), বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়।

তাদের হাত ধরে মহাস্থানগড় ও কুমিল্লার ময়নামতিতে পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার গড়ে ওঠে, যা ছিল মূলত শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। আমরা আরও জানি যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার সীমান্তে বিহারের নালন্দায়।

বাংলা সুলতানি আমলে সাহিত্য–সংস্কৃতিতে এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে। এর পেছনে সুলতানি আমলের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বর্ণনাতীত।

সুলতানি আমল থেকে মোগল আমল পর্যন্ত বাঙালির জীবনাচার, তার সাহিত্য–সংস্কৃতিতে ইরান–পারস্য, তথা মধ্য এশিয়া এবং আরবের থেকে আসা জনগোষ্ঠীর প্রভাব দৃঢ়ভাবে লক্ষণীয়।

খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে পোশাক, ভাষা, স্থাপত্য শিল্প, তথা জীবনাচরণ সব ক্ষেত্রে এভাবে সংস্কৃতির গতিময়তা, সামাজিক পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের বৃহত্তর বাংলায় সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের হরেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।

আরও পড়ুন

এই পরিবর্তন ভূখণ্ডের সব জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিকে তার শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়।

সতেরো শতকে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই গতিময়তার এক রকম ছন্দপতন ঘটে এবং ঘটানো হয়।

কারণ, ইউরোপীয় বণিকসহ আরও যাঁরা নানা সময় বাংলায় এসেছিলেন, তাঁরা মূলত এসেছিলেন বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে।

সে ক্ষেত্রে মোগল বা সুলতানি শাসকেরা ছিলেন ব্যতিক্রম। যাঁরা মধ্য এশিয়া, তুরস্ক বা ইরান থেকে এসে রাজ্য জয় করে ভারতবর্ষের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজ্যগুলো দখল করলেও তাঁরা এই দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

এ দেশে সমাজ–সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বসবাস করতেন, তাঁরা তাঁদের ফেলে আসা দেশে সম্পদ পাচার করেননি।

পক্ষান্তরে ইউরোপীয় আর ইংরেজ শাসকবেনিয়া ২০০ বছরে ট্রিলিয়ন সমমূল্যের সম্পদ আমাদের বাংলাদেশ, তথা ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে গেছে পাচার করে এবং সেই জন্য ভারত, তথা বঙ্গদেশে দুই–দুটি মহামন্বন্তর সংঘটিত হয়েছিল।

এই মহামন্বন্তরের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের অনাহারে, রোগে ভোগে প্রাণহানি ঘটেছিল।

আরও পড়ুন

ফলে আমাদের জীবনাচার, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং ব্রিটিশবিরোধী একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে আঠারো শতকের সময় এসে।

এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে লড়াইয়ে বৃহত্তর বাংলায় আমাদের সমাজজীবনে যে ঐক্য ছিল, সেখানে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী দূরে চলে যায়! ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর কারণ, বাংলা প্রদেশে অনুশীলন এবং যুগান্তর সংঘ। সশস্ত্র বিপ্লবীদের লড়াই শুরু করে সেখানে সনাতন ধর্মীয় দেব-দেবীদের উপাসনা, ধর্মীয় উপাদান থাকার কারণে মুসলিম সমাজ এই আন্দোলনে লড়াইয়ে যুক্ত হয়নি।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উত্তর ভারতীয় নেতৃত্বে মুসলিম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলার নেতৃত্বের যে বিরোধিতা, সেটিও মুসলিম মানসে প্রভাব ফেলেছিল।

ফলে এ জন্যও দেশের হিন্দু–মুসলমান দুটি বড় সম্প্রদায়ের ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদল ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’, এই ষড়যন্ত্রনীতি অনুসরণ করে হিন্দু–মুসলমিদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়।

ফলে সাতচল্লিশে ভুল দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়।

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাক্‌স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতিকে দমিয়ে রেখে শুধু উন্নয়নের দর্শন দিয়ে যে রাষ্ট্র–সমাজ পরিচালনা করা যায় না, তার প্রমাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি আমাদের বৃহত্তম অংশকে সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া এবং পাহাড়–সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের একটি সংস্কৃতি বিনির্মাণ।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকেরা ব্রিটিশদের মতোই বাংলাকে স্রেফ একটি উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে থাকেন। এর বিরুদ্ধে বাংলায় প্রথমে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন।

এরপর ধাপে ধাপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং এই জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে সংস্কৃতিতে একটি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়, সেটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মগ্রহণ করে।

স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদীর যে আবেগ, সেই আবেগকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল জাতির আবেগকে পুঁজি করে, সেই কৌশল আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের পথে আরেকটি বাধার প্রাচীর গড়ে তোলে।

এর মূল কারণ, জাতীয়তাবাদ শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলে না, কৃষক–শ্রমিক–মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম–লড়াই জাতীয়তাবাদ ধারণ করে না।

ফলে দেশে বুর্জোয়া এবং মেহনতি মানুষের একটি বিরাট বিভাজন তৈরি হয়।

দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের পুঁজিপতিরা লুটেরা বুর্জোয়ায় পরিণত হয়, তারা বিদেশের সম্পদ পাচার করে ব্রিটিশদের মতোই, যা আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর।

আরেকটি বিষয়, আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিবিদেরা এবং সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের একটি বিরাট অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়ের আবেগ, মানসিকতা এবং ক্ষুদ্র সাঁওতাল, চাকমা তাদের সংস্কৃতিকে মূলধারায় যুক্ত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক বিভাজন, ঐক্যের ঘাটতির সুযোগে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহজে শিকড় গেড়ে বসে এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনের রাজনৈতিক অভিঘাতে অর্থনৈতিক পরাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে স্বাধীনভাবে বিকাশে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়।

যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনকে বিপথে নিয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো চাপিয়ে দিয়ে এবং সেই মতো দেশের শাসকশ্রেণি নিজেদের মতো বলে উন্নয়নের দর্শন প্রচার করে এবং সেখানে মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়ন করে উন্নয়ন নিয়ে নতুন বয়ান জনগণের সামনে উপস্থাপন করে।

বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাক্‌স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতিকে দমিয়ে রেখে শুধু উন্নয়নের দর্শন দিয়ে যে রাষ্ট্র–সমাজ পরিচালনা করা যায় না, তার প্রমাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি আমাদের বৃহত্তম অংশকে সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া এবং পাহাড়–সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের একটি সংস্কৃতি বিনির্মাণ।

এটা করতে পারলে আগামী দিনে সাধারণ মানুষের বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। এ জন্য বর্ণজাতি–নির্বিশেষে সবাই যাতে সেই সংস্কৃতিকে আপন বলে ভাবতে পারে, সেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা, যা হবে সংস্কৃতি বিকাশের নয়া পথ।

  • নাজমুল ইসলাম সভাপতি, উদীচী গোপালগঞ্জ জেলা সংসদ।