রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ইউক্রেনে আক্রমণের আদেশ দিয়েছিলেন, তখন তিনি দ্রুত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করে ইউক্রেনে সরকার পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু পুতিন সফল হতে পারেননি। ইউক্রেনে এখনো লড়াই চলছে। এই লড়াই কখন কীভাবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। যদি কেউ এই সংঘাতকে ইউক্রেনের ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ হিসেবে দেখেন, তাহলে তিনি ইউক্রেনের সীমানা কতটা দখল হয়েছে, সেদিকে খুব বেশি মনোযোগ না দিয়েই বলতে পারেন, ইউক্রেনীয়রা ইতিমধ্যে জয়ী হয়েছেন।
এ ছাড়া ইউক্রেনের ব্যাপারে পুতিনের আচরণ ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করে দিয়েছে।
এই যুদ্ধ থেকে এর বাইরে আমরা আর কী শিখেছি? প্রথম আমরা শিখলাম পুরোনো এবং নতুন অস্ত্র একে অপরের পরিপূরক।
রাজধানী কিয়েভ রক্ষায় ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রাথমিক সাফল্যের পর আধুনিক যুদ্ধে ট্যাংক-যুগের সমাপ্তি ঘটেছে বলে অনেকে মন্তব্য করছিলেন।
ওই সময় আমি সঠিকভাবেই সতর্ক করেছিলাম, ট্যাংক যুগের সমাপ্তি হয়েছে বলে যে ঘোষণা আসছে, তা অপরিপক্ব প্রমাণিত হতে পারে। কারণ, যুদ্ধটি উত্তর শহরতলি থেকে ইউক্রেনের পূর্ব সমভূমির দিকে চলে গেছে।
অবশ্য তখনো আমি ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ড্রোনের কার্যকারিতা অনুমান করতে পারিনি।
কখনো আমি ভাবতে পারিনি, ইউক্রেন কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম দিকের অর্ধেক এলাকা থেকে রুশ নৌবাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এই যুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় যে পাঠ আমরা নিতে পারি, সেটি হলো পারমাণবিক অস্ত্র শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখতে কাজ করে। পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের হুমকি ন্যাটোকে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোয় বাধা দিয়েছে।
তবে বিষয়টি এমন নয় যে ইউরোপের চেয়ে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা বেশি। রাশিয়ার ইউরোপকে ঠেকিয়ে রাখতে পারার বড় কারণ হলো, পুতিন ইউক্রেনকে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে নিলেও ইউরোপের নেতারা বিষয়টি সেভাবে ভাবেননি।
তবে পুতিনের হুমকি ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পাশাপাশি পুতিনকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে হামলা চালানো থেকে পশ্চিমারা ঠিকই বিরত রাখতে পেরেছে।
তৃতীয় শিক্ষণীয় বিষয় হলো, অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যুদ্ধ এড়ানোর নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কিছু জার্মান নীতিনির্ধারক অনুমান করেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার জন্য রাশিয়া এবং ইউরোপ উভয় পক্ষকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
এ কারণে কোনো পক্ষই প্রকাশ্য শত্রুতায় জড়াবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা যুদ্ধ ঠেকাতে পারে না বরং যুদ্ধের খরচ বাড়াতে পারে।
চতুর্থ শিক্ষণীয়টি হলো কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে স্বল্প মেয়াদে ভালো কোনো ফল পাওয়া যায় না, বরং খরচের হিসাব লম্বা হতে থাকে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর রাশিয়া বিকল্প মিত্র বেছে নিয়েছে।
রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি কিনেছে ভারত ও চীন। বরং রাশিয়া থেকে তেল আনতে না পারায় ইউরোপের অনেক দেশের মধ্যেই অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
পঞ্চম পাঠ হলো, তথ্যযুদ্ধের ধরন এখন অনেক পাল্টে গেছে। আধুনিক তথ্যযুদ্ধে কোন পক্ষের সেনাবাহিনী জিতেছে, শুধু সেটিকে বড় করে প্রচার করাই শেষ কথা নয়, বরং কে কোন গল্প বা ভাষ্যকে বেশি বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করতে পারছে, সেটি বড় বিষয়।
অনেক বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ইউক্রেনের অবকাঠামো এবং সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাইবার হামলা অসাধ্য সাধন করবে। ড্রোন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগগুলো সাইবার হামলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব। সেটি যুদ্ধকে এখন আরও জটিল করে তুলেছে।
ষষ্ঠ পাঠ হলো, যুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করার জন্য সফট পাওয়ারও প্রয়োজন। পুতিন শুরুর দিকে সাফ পাওয়ারের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
ইউক্রেনে হামলার প্রথম দিকে বিশ্ববাসীর কাছে পুতিনের সমর্থন কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী ভূমিকা তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
এই সফট পাওয়ার জেলেনস্কি ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অনেক বেশি সাহসী করে তুলেছে।
সপ্তম শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, আধুনিক যুদ্ধে সাইবার সক্ষমতা বুলেটের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাশিয়া কমপক্ষে ২০১৫ সাল থেকে ইউক্রেনের পাওয়ার গ্রিডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সাইবার অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
অনেক বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ইউক্রেনের অবকাঠামো এবং সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাইবার হামলা অসাধ্য সাধন করবে। ড্রোন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগগুলো সাইবার হামলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব। সেটি যুদ্ধকে এখন আরও জটিল করে তুলেছে।
● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত