বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এতটা বিভক্ত যে কোনো দুজন নাগরিককে একটি বিষয়ে প্রশ্ন করলে সম্পূর্ণ ভিন্ন উত্তর পাওয়া যাবে। যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘দেশ কেমন চলছে?’ একজন উত্তর দেবেন, ‘দেশ খুব ভালো চলছে। এ রকম মুক্ত গণতন্ত্র দেশে কখনো ছিল না। ধাই ধাই করে এগিয়ে চলেছে অর্থনীতির সব সূচক।’ অপরজন জবাব দেবেন, ‘দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। দুর্নীতি–পাচার অর্থনীতিকে শেষ করে দিয়েছে। এই সরকার আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে।’
সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) জরিপেও পরস্পরবিরোধী সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দেশের ৬৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন আছে বিরোধী দলের প্রতি। আবার ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ভালো করেছেন।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময় ব্যক্তি বা নেতাকেন্দ্রিক। দলগুলোও চলে শীর্ষ নেতার নির্দেশে। সেই অর্থে বিরোধী দল বিএনপির ‘নেতা’ নেই সাড়ে পাঁচ বছর। দলের প্রধান খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে (যদিও সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি বর্তমানে নিজ বাড়িতে আছেন) ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। তাঁর অনুপস্থিতিতে যাঁকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে, সেই তারেক রহমান ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিদেশে। তিনিও বেশ কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত। তারপরও প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি যে রাজপথ গরম রেখেছে, তার কৃতিত্ব দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদেরই।
বিএনপি আন্দোলন করতে পারে না বলে এত দিন আওয়ামী লীগ নেতারা যে উপহাস করতেন, সেই উপহাস এখন তাঁদের দিকেই ফিরে এসেছে। অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম বলতে হরতাল, অবরোধ ও ঘেরাওকে বোঝাত। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিও এই ধারা অনুসরণ করে আসছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
বিএনপি যদি মনে করে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে কিংবা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে এবং তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে, সেটা বাস্তবতাবিবর্জিত বলেই মনে করি। এমনকি নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাও কম। গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই কথা বলে। কিন্তু এসব কথার আড়ালে বা সমান্তরালে যে সত্য থাকে, সেটি হলো তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সাম্প্রতিক কালে বিএনপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কিছুটা হলেও নতুনত্ব এনেছে। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শহর ছাড়িয়ে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং তাতে মানুষের সাড়াও মিলেছে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিএনপি যেদিনই কর্মসূচি নেয়, আওয়ামী লীগও সেদিন প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকে। এর পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা যেসব যুক্তি দেখান, সেটাও হাস্যকর। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি এতটাই দুর্বল যে বিএনপি-জামায়াতের কথিত সন্ত্রাস–নৈরাজ্য মোকাবিলা করতে পারে না?
ভবিষ্যতে যদি বিএনপি হরতাল–অবরোধের মতো কঠিন কর্মসূচি দেয়, তাহলে আওয়ামী লীগও কি তাকে অনুসরণ করবে?
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঝগড়া তো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে। আমাদের এত বড় বড় বিজ্ঞ নেতা–নেত্রী আছেন, কিন্তু ৫২ বছরে নির্বাচনটা কীভাবে হবে, সেটা ঠিক করতে পারলেন না। বিরোধী দলে থাকতে তাঁরা বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এত ভালো ব্যবস্থা আর হয় না। কেউ কেউ এই ব্যবস্থা বিদেশে রপ্তানি করার কথাও বলেছিলেন। ক্ষমতায় গিয়ে আবার সেই নেতারাই বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার নামই নেওয়া যাবে না; এটি সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করেছেন। কিন্তু আদালত সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিলেন, সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন এ ব্যবস্থায় হতে পারে। নেতারা সংবিধানের ব্যাখ্যাও তো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী দেন।
বিএনপি সরকার যখন চতুর্দশ সংশোধনী করে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল, আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করেছিল। আমরা মনে করি, সেই বিরোধিতা ন্যায়সংগত ছিল। এখন আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের দোহাই দিলেও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলে না।
সরকারের দমননীতি ও সরকারি দলের পাল্টা কর্মসূচি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে লোকসমাগম বেড়েছে। এটাকে দলের নেতারা আন্দোলনের সাফল্য হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এ সাফল্যকে তাঁরা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি? বিএনপির ভাষায় চূড়ান্ত ফয়সালা মানে নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস বাকি। নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, আগামী অক্টোবরের শেষে অথবা নভেম্বরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর মধ্যে বিএনপির নেতারা যাকে রাজপথের ফয়সালা বলছেন, সেটি করার প্রস্তুতি তাদের আছে কি? দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত, পাচার–দুর্নীতি বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ক্ষোভকে বিরোধী দল কতটা কাজে লাগাতে পারবে?
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যেভাবে মানুষের সমর্থন পাওয়া গেছে, চূড়ান্ত ফয়সালায় সেটা পাওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। ২৯ জুলাইয়ে ঢাকার প্রবেশপথে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে মানুষ দেখেছে দুই পক্ষের সংঘাত হিসেবে। তারা নিজেরা সরাসরি কোনো পক্ষ হতে চায়নি।
আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপিতে দুটি ধারা সব সময়ই ছিল। গত বছর ১০ ডিসেম্বরের আগে দলের অধিকাংশ নেতা সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে রাজি থাকলেও কট্টরপন্থীদের জন্য পারেননি। কট্টরপন্থীরা সে সময়ই সরকারের বিরুদ্ধে সমুখসমরে নামার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এবারও বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, দু–চারটি গরম কর্মসূচি দিলেই গণ-অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাঁদের যুক্তি হলো, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তাতে তাদের পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপি এক দফা কী করে আদায় করবে, দলের একাধিক নেতার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে তঁারা বলেছেন, দেখুন না কী হয়। এর মাধ্যমে তাঁরা আমেরিকার নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বাংলাদেশে অতীতে কোনো আন্দোলনে কোনো সরকারই সহজে পদত্যাগ করেছে, এমন নজির নেই। প্রশাসন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি বিরুদ্ধে গিয়েছিল বলে নব্বইয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, বাম, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে ফেলেছিলেন। পরে প্রশাসন সমর্থন তুলে নেওয়ায় তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের ‘লগি–বইঠার’ আন্দোলনও ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পরে এক–এগারোর পটপরিবর্তনের কারণে সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।
বিএনপি যদি মনে করে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে কিংবা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে এবং তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে, সেটা বাস্তবতাবিবর্জিত বলেই মনে করি। এমনকি নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাও কম। গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই কথা বলে। কিন্তু এসব কথার আড়ালে বা সমান্তরালে যে সত্য থাকে, সেটি হলো তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
বিদেশি শক্তির ওপর ভরসা করে যদি বিএনপি এক দফার আন্দোলন করে থাকে, সেটা ভুল হবে। দেশের মানুষের ওপরই তাদের ভরসা করতে হবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
ই–মেইল: [email protected]