সেই সব হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য আমাকে ঘুমাতে দেয় না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আঁকা একটি গ্রাফিতিছবি: দীপু মালাকার

৫ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। উন্নয়নের দর্পে মাটির অনেক ওপর দিয়ে ছুটে চলা উড়ালসড়কেরও ভিত্তিস্তম্ভকে মাটি ছুঁয়ে দাঁড়াতে হয়। তারই আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু হতভাগ্য মানুষ। কেউ নারী, কেউ পুরুষ, কেউ ছাত্র, কেউ কিশোর।

যারা ভিডিও করছে, তাদের ভাষায় এদের কেউ হুজুর। কারণ, পরনে মাদ্রাসাছাত্রের সাদা আলখাল্লা। সাংঘাতিক কোনো অস্ত্র নেই তাদের হাতে। দু–একটা মাঝারি গোছের লাঠি চোখে পড়তে পারে কারও কারও হাতে। আর কিছু নেই। মাথা নিচু করে সড়ক বিভাজকের চেয়েও নিচু হয়ে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা এই মানুষগুলোর। তারা জানে না, আর কয়েক ঘণ্টা জীবন আঁকড়ে থাকতে পারলেই তারা হবে বিজয় মিছিলের একেকটি মুখ।

তারিখটা ৫ আগস্ট। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সকালের দিকে হবে। ছাত্ররা ডাক দিয়েছে, ঢাকা চলো! সাড়া দিয়েছে একটা দেশের আপামর জনতা। এই হতভাগ্য মানুষগুলো তাদের কয়েকজন।

পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ বাহিনীর অল্প কিছু সদস্য। যাঁদের ব্যাপারে সেদিন সকালেও তিনি অন্য বাহিনীর প্রধানদের বলেছেন, পুলিশ তো পারছে, আপনারা পারছেন না কেন? পরনে হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, সুকঠিন বুট জুতো। হাতে কালো কুচকুচে শটগান। ট্রিগারের একেকটি চাপে ক্ষমতার পরম প্রকাশ একেকটি পেলেট ছুটে আসার জন্য প্রস্তুত!

মানুষগুলো মাথা নিচু করে লুকিয়ে আছে। যারা ভিডিও করছে অনেক দূর থেকে, তারা যেন নিজেকেই বলছে, এরা পালায় না কেন? পুলিশ তো এসে পড়ল! আল্লাহ, তুমি পুলিশকে হেদায়েত দাও! ভিডিও দেখতে দেখতে নজরুলের কবিতা মনে পড়ছে:

যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা,

সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা?

উদার আকাশ বাতাস কাহারা

করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা?

তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান?

হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?

ভগবান! ভগবান!

প্রতিবিধান হবে বৈকি! কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য বড্ড দেরিতে। রাস্তা পেরিয়ে একে একে এগিয়ে আসে মৃত্যুদূতেরা। শুরু হয় গুলি। নুয়ে থাকা, ঝুঁকে থাকা মানুষগুলো একে একে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। অনেক দূর থেকে করা ভিডিওতেও স্পষ্ট দেখা যায় ধীরে ধীরে ধূসর রাজপথ রক্তিম হয়ে উঠছে। কেউ দুহাত ওপরে তুলে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। গুলি থেমে নেই। একজনকে ধরে আবার ছেড়ে দেওয়া হলো। দৌড়ে পালাচ্ছেন তিনি! গুলি তবু চলছে! খানিক বাদে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সাদা আলখাল্লা নওশার রঙে রেঙে উঠল।

যে পুরুষ ভিডিও করছিলেন তিনি নারীদের বলছিলেন, তোমরা আর দেখো না, সরে যাও! কিন্তু রাস্তায় যে নারী, তাঁর পরিণতি না দেখে কি যাওয়া যায়? গুলি চলছে। ওরা তো বলেছে, পাঁচ বছর প্রতি সেকেন্ডে গুলি করলেও তা শেষ হওয়ার নয়!

৫ আগস্টের পর থেকে সব ভুলে যেতে চাইছি। বলছি রাষ্ট্র মেরামতের কথা। কিন্তু এই রকম ছবি কিছুতেই ভুলতে দিচ্ছে না। যেন একই দুঃস্বপ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। মিনিট দেড়েকের আরেকটি ভিডিও, গ্রেনেড নয়, ককটেল নয়, মারাত্মক বিধ্বংসী ঢিল ছুড়ছে কয়েকজন। উঁচু কোনো ভবন থেকে করা ভিডিও।

আশপাশে কোনো পুলিশের দেখা নেই। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। একজন লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল ঠিক একজনের রক্ত। সঙ্গে মনে পড়ে গেল সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চিন্তাক্লিষ্ট মুখ। লাশের ভিডিও দেখে তিনি বিচলিত নন। বিচলিত, একজনকে গুলি করলে শুধু একজনই কমছে। বাকিরা তো পালাচ্ছে না!

ভুলে যেতে চাই সব। ভুলে যেতে চাই বুক পেতে দাঁড়ানো আবু সাঈদের কথা। পুলিশের দায়ের করা এজাহারে যার মৃত্যুর কারণ ‘আন্দোলনকারীদের এলোপাতাড়ি গুলি’। ভুলে যেতে চাই ফারহানকে, মুগ্ধকে। কিন্তু প্রতি রাতে ওরা আমাকে ঘিরে ধরে। পালাতে চাই! পারি না! ওরা যে অনেক। কতজন তা–ও ঠিক ঠাহর করতে পারি না। ওরা আরও কাছে চলে আসে। চেপে ধরে রীতিমতো! প্রশ্ন করে, ‘হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?’

রাষ্ট্র মেরামতের স্বপ্ন দেখেছিল ওরা। তার চেয়েও বেশি করে একটা স্লোগান ওরা বারবার দিয়েছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস! বিচার চাই। চাকরি চাই না, ভাই হত্যার বিচার চাই! শহীদের রক্তের বদলা চাই! আর আমি রাতে একটু ঘুমাতে চাই। কিন্তু শহীদেরা তো মৃত্যুহীন। তারা চিরঞ্জীব! তারা বদলা না নিয়ে ফিরে যাবে না! তাই আজ আমাদের প্রথম কাজ এই খুনের, নির্বিচার হত্যার বিচার করা। শেখ হাসিনা আর দোসরদের বিচার হতেই হবে। তার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হোক।

  • মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী