‘আমাদের আমলে তো মানসিক অসুখ ছিল না, তোমাদের এত মানসিক সমস্যা কেন?’—কিশোরী মেয়ের প্রতি বাবার প্রশ্ন। দশম শ্রেণির ছাত্রীটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তার বোনের বিষণ্নতা আছে, কিন্তু বাবা চিকিৎসার উদ্যোগ নিচ্ছেন না। কারণ, অল্প বয়সীদের যে মানসিক রোগ হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি সচেতন নন। কিশোরীটি বলল, কয়েক মাস আগে তার এক সহপাঠী আত্মহত্যা করেছে। পরীক্ষার ফলাফলের পর মা-বাবার বকাঝকায় এ ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের ১০৫টি জাতীয়-স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে সারা দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীর হার ৪৬ দশমিক ৮-এর বেশি। আত্মহত্যার নানা কারণ থাকে, মানসিক অসুস্থতা এর একটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক—এই তিন অবস্থার সমন্বয়। একজন মানুষের স্বাস্থ্য হলো নীরোগ শরীর; সেই সঙ্গে ভয়, হতাশা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত এবং সমাজের নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম মন। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হলো মনের সুস্থতা। মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণ মিলেই মানসিক স্বাস্থ্য। যেকোনো সময়ে একজন ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা কেমন হবে, তার পেছনে একাধিক সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক কারণ থাকে।
বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮ দশমিক ৭। বিশ্বে আত্মহত্যা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অর্ধেকের বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ১৪ বছরের আগে শুরু হয়। পৃথিবীর ২০ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরীর মানসিক অসুস্থতা আছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের স্বীকৃতি।
বাংলাদেশে মানসিক রোগ নিয়ে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। অনেকে মনের অসুখকে একধরনের বিচ্যুতি বা দুর্বলতা বলে মনে করেন। অসুস্থ ব্যক্তিরা পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে অনেক বৈষম্যের শিকার হন। তাঁদের নিয়ে চলে নির্দয় হাসিঠাট্টা। এ কারণে কারও কারও মধ্যে মানসিক অসুস্থতা গোপন করার প্রবণতা দেখা যায় এবং চিকিৎসা নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা থাকে। কিন্তু ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে অনেক মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তি কর্মক্ষম জীবন যাপন করতে পারেন।
কোনো কোনো মা-বাবা ও অভিভাবক আক্ষেপ করেন, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে পারলে তাঁরা হয়তো আগেই সন্তানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতেন। এ বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। মানসিক অসুস্থতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগ কোনো অপরাধ বা ব্যর্থতা নয়।
নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা, পড়াশোনার চাপ, খেলাধুলা, সুস্থ বিনোদনের অভাব ইত্যাদির কারণে বর্তমানে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা স্ট্রেস বা চাপের মধ্যে থাকে। বেশির ভাগ শিশু স্ট্রেস অনুভব করে, যখন তারা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। এর মধ্যে আছে বয়ঃসন্ধির শুরু, স্কুলে পরীক্ষা ও অত্যধিক বাড়ির কাজ, বন্ধুদের সঙ্গে ও সামাজিকতা রক্ষায় সমস্যা, বড় কোনো পরিবর্তন (যেমন বাড়ি বা স্কুল বদল, মা-বাবার বিচ্ছেদ), দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, পরিবারে আর্থিক সমস্যা ইত্যাদি। অল্প পরিমাণে স্ট্রেস শিশু ও বড়দের জন্য ভালো হতে পারে, যেমন পরীক্ষা বা বক্তৃতা ভালো করে দেওয়ার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করে। তবে স্ট্রেস যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তা একজন ব্যক্তির মেজাজ, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা কি শিশুদের জীবনে ক্রমবর্ধমান চাপ এবং তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, সে বিষয়ে সচেতন?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অনুযায়ী, যদি কোনো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে অথবা নিজেকে বা অন্য কাউকে আঘাত করতে চায়, তাহলে অবিলম্বে মনোরোগ চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে। এর পাশাপাশি কিছু উপসর্গ সম্পর্কে মা-বাবা ও অভিভাবকেরা সচেতন থাকলে সঠিক সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব। শিশুদের ক্ষেত্রে নিচের লক্ষণগুলো দেখলে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, যাতে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করতে পারেন—শিশু যদি ঘন ঘন রেগে ওঠে অথবা বেশির ভাগ সময় তীব্রভাবে খিটখিটে হয়, প্রায়ই ভয় বা উদ্বেগের কথা বলে, কোনো কারণ ছাড়া বারবার পেটব্যথা বা মাথাব্যথা সম্পর্কে অভিযোগ করে, সব সময় অস্থির থাকে এবং চুপ করে বসে থাকতে না পারে, খুব বেশি কিংবা কম ঘুমায়, দুঃস্বপ্ন দেখে, অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে আগ্রহী না হয় অথবা বন্ধুত্ব করতে না পারে, পরীক্ষায় হঠাৎ খারাপ ফল করে ইত্যাদি।
কিশোর-কিশোরীদের জন্য মনোরোগ চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে, যদি তারা যে বিষয়গুলো উপভোগ করত সেগুলোয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাদের দুর্বল লাগে, খুব বেশি কিংবা কম ঘুমায় অথবা সারা দিন তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করে, বেশির ভাগ সময় একা থাকে, বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলে, ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে অথবা খুব কম খায়, নিজেকে আঘাত করে; ধূমপান, মদ্যপান অথবা মাদক গ্রহণ করে; একা বা বন্ধুদের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বা আক্রমণাত্মক আচরণে লিপ্ত হয়, আত্মহত্যার চিন্তা করে, ভাবে যে কেউ তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে বা তারা এমন কিছু শোনে, যা অন্যরা শুনতে পায় না।
কোনো কোনো মা-বাবা ও অভিভাবক আক্ষেপ করেন, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে পারলে তাঁরা হয়তো আগেই সন্তানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতেন। এ বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। মানসিক অসুস্থতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগ কোনো অপরাধ বা ব্যর্থতা নয়। শিশু ও বয়স্ক যে কারোরই মানসিক অসুখ হতে পারে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। এ রকম লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী