বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। ২৯ জুনও এই বাজেট সংসদে পাস হয়ে গেছে। কিছু জরুরি খাতে অযৌক্তিকভাবে অত্যন্ত কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে বাজেটে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির স্বল্প আয়তনের, সংকীর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সে দুটি খাতের একটিও বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল খাত
সরকারি অর্থের বরাদ্দ ও খরচ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় খাতেই হতে পারে। উৎপাদনশীল খাত বলতে যেসব আর্থিক খাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ ও সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, সেগুলোকে বোঝায়। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি। অনুৎপাদনশীল খাতের মধ্যে পড়ে জনপ্রশাসন (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান), প্রতিরক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া ইত্যাদি।
কিছু উৎপাদনশীল খাত এমনও আছে—অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেগুলোর অবদান সরাসরি চোখে পড়ে না। কারণ, সেসব খাতের বেশ দীর্ঘ সুপ্তিকাল থাকে। শিশু-কিশোরদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ১৬ থেকে ২০ বছর ধরে চলে, এ সময়ে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু উৎপাদন করে না। কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (প্রশিক্ষণ) মানবসম্পদের উন্নয়ন করে প্রায় সরাসরি; এর সুপ্তিকাল একেবারে অল্প হওয়ায় উন্নয়ন সহজে চোখে পড়ে। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ খুব তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাস্থ্যবান মানুষ কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্যহীন ও রোগাটে কর্মীদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বলে স্বাস্থ্য খাতে খরচকে শিক্ষা খাতের চেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানকারী হিসেবে দেখা যায়।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খাতের সুপ্তিকাল দীর্ঘ হলেও দেশের উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা থাকে। এসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বর্ধিত আয়ের যোগ্যতা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাড়তি প্রভাব ফেলে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ
প্রায় ৬০ বছর আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্যাপিটাল স্কুল শিক্ষা খাতের খরচকে বিনিয়োগ বলে প্রমাণ করে রেখেছে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তঃসত্ত্বা প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে ভেতর থেকে; এর অবদান বাহ্যিক মডেলের বিশ্লেষণেও সরাসরি ধরা পড়ে না। ভেতর থেকে গড়ে ওঠা এই উন্নয়ন হয় দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃত উন্নয়ন।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেসকো) দীর্ঘদিন শিক্ষা খাতে জিডিপির শতকরা ৭ ভাগ বরাদ্দের দাবি করে আসছিল। তবে সংস্থাটি ২০১৫ সালের ইঞ্চিয়ন ঘোষণায় এই খাতে জিডিপির ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে। এর কম বরাদ্দে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) (শিক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এসডিজি-৪) অর্জন করা যাবে না।
শিক্ষা খাতে উন্নত বিশ্বের আর্থিক বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে আমরা এশিয়ার কিছু নিকট প্রতিবেশীর দিকে তাকাই। ভুটান এই খাতে জিডিপির ৭.২ শতাংশ বিনিয়োগ করে। ভারত ও পাকিস্তানের এই খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮ ও ২.৯ শতকরা।
অনেক বছর বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে জিডিপির প্রায় শতকরা ২ ভাগ বরাদ্দ করা হচ্ছিল। ‘নতুন’ নামে খ্যাত পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য গতবার অন্য বছরের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দরকার ছিল; কিন্তু সেবার বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র ১.৭৬ শতাংশ! অত্যন্ত দুঃখজনক, জিডিপির হিসাবে এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আর এক দফা কমিয়ে ১.৬৯ শতাংশ করা হয়েছে!
স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে অবহেলিত
মানবসম্পদ উন্নয়নের বিচারে স্বাস্থ্য শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারণ, স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে শিক্ষা গ্রহণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। শরীর সুস্থ না থাকলে শিক্ষার মতো উন্নত মানসিক কাজ ভালো হতে পারে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউ) হিসাবমতে বাংলাদেশে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫.২৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এই হিসাব দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন¤দেশটির পরে (অল্পের জন্য নিচের দিক থেকে প্রথম হওয়ার ‘গৌরব’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি!)। স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের সংখ্যার চেয়ে সেবিকার সংখ্যা বেশি হতে হয়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন সেবিকা থাকেন। বাংলাদেশে এই হার উল্টো; ২.৫ জন চিকিৎসকের জন্য আছেন মাত্র একজন সেবিকা। এর কারণ কি এই যে আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেবিকা তৈরির জন্য যথেষ্টসংখ্যক নারী নেই? না থাকলে কোত্থেকে আমরা যুবতীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাই ঘরকন্নার কাজ করার নামে নানাভাবে নিগৃহীত হতে?
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত গত বছর স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির প্রায় ২.২% খরচ করেছে; ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এই খাতে ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে।
মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট বরাদ্দ
বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৩৮ টি; হিসাবের সুবিধার্থে আমি ২টি বাড়িয়ে ৪০টি ধরে নিচ্ছি। প্রতি মন্ত্রণালয়ের ভাগে পড়ে জিডিপির ২.৫ শতাংশ। দুটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাগ দাঁড়ায় জিডিপির ৫ শতাংশ যা ইউনেসকো-নির্ধারিত ৪-৬ শতাংশের মাঝখানে পড়ে। অথচ জিডিপির হিসাবে এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরেক দফা কমিয়ে ১.৬৯ শতাংশ করা হয়েছে! আমাদের একক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো হিসেবে জিডিপির ২.৫ শতাংশ ভাগে পায়। সেখানে কোন যুক্তিতে গত বছর ০.৭৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল? এবার কোন যুক্তিতে আরও কমিয়ে স্রেফ ০.৭ শতকরা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলো? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত বারবার যৌক্তিক ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন?
অমর্ত্য সেনের আবিষ্কার এবং আমাদের মন্ত্রিপরিষদ
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুই দশক আগে আবিষ্কার করলেন ‘গণতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ আমরা যা–ই ভাবি না কেন, আমাদের নেতারা দিবা–নিশি দেশে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ ঢোল সজোরে বাজিয়েই চলেছেন। তাহলে দুর্ভিক্ষ কেন?
না, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্য নিয়ে দুর্ভিক্ষ একবারই হয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন না বোঝা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্য আর্থিক বরাদ্দের অর্ধেকও না দেওয়া থেকে মনে হয় আমাদের মন্ত্রিপরিষদে চলছে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’।
মনে রাখতে হবে: বড় সেতু, উড়ালসড়ক, শুধু রাজধানীতে ওভারহেড মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দূর থেকে দেখা যায়; ‘দেখানো’ও যায় বেশ গর্বের, দর্পের, এমনকি দম্ভের সঙ্গে। দেখিয়ে বহু মানুষের মনও জয় করা যেতে পারে; কিন্তু গণমানুষের ভেতর থেকে উন্নয়ন না ঘটলে, মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে না পারলে ইট-পাথর-লোহায় গড়া বাহ্যিক উন্নয়ন সবই যে বৃথা হয়ে যাবে!
আশা করি, আমাদের ব্যবসায়ী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের দায়িত্ব বা ব্যবসা ভালোমতো বুঝে মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারণা কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংসদে পাস করবেন। শিক্ষা খাতে অন্তত ৩% এবং স্বাস্থ্য খাতে অন্তত ১.৫% বরাদ্দ নিশ্চিত করবেন। আর আগামী বছর থেকে প্রাপ্য হারে (শিক্ষায় ৫ %, স্বাস্থ্যে ২.৫ %) বাজেটে বরাদ্দের চিন্তা মাথায় রাখবেন।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষা গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)।