আসুন, বঙ্গবাজার থেকে ঈদের কিছু কেনাকাটা করি

দশ দিন আগেও এখানে জমজমাট ব্যবসা ছিল। আগুনে পুড়ে সব শেষ এখন। তবুও ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বঙ্গাবাজার মার্কেট।
ছবি: প্রথম আলো

দোকানে সাজানো ছিল কাপড়চোপড়—শাড়ি, থ্রি-পিস, ছোটদের গেঞ্জি সেট, বড়দের জিনস, জামা-জুতা। ঈদে বেচাবিক্রি হবে, সেই টাকা দিয়ে দোকানের কর্মচারীদের ঠিক সময়ে বেতন-বোনাস দেওয়া হবে, নিজেদের ঈদ মোটামুটি ভালো কাটবে—এমন চিন্তা ছিল ব্যবসায়ীদের, প্রতিবার যেমন থাকে।

বঙ্গবাজারে যাঁদের যাওয়া-আসা আছে তাঁরা জানেন, সেখানকার ব্যবসা, বেচাকেনা মোটের ওপর সব সময়ই ভালো। পাইকারি ও খুচরা, একই সঙ্গে চলে সেখানে। ঢাকার বাইরে থেকে গাঁট ভরে মাল কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। আর খুচরা কেনাকাটার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিশেষ পছন্দ এই বঙ্গবাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা—এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হরহামেশা বঙ্গবাজার থেকে কেনাকাটা করে থাকেন। আমরা ছাত্রজীবনে বঙ্গবাজার থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করেছি। বিশেষ করে শীত আসার আগে জ্যাকেট, সোয়েটার ও জুতা কেনার জন্য ওই মার্কেটকেই বেছে নিতাম।

ঢাকায় যেসব বিদেশি বসবাস করেন, তাঁদেরও বিশেষ পছন্দ এই বঙ্গবাজার। কোরীয়, চায়নিজরা তো আছেনই, ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইরানিদের এসব মার্কেটে ঢের দেখেছি। বঙ্গবাজারে দেখা হয়েছে একেবারে সাদা চামড়ার ইউরোপীয়দের সঙ্গেও। তাঁদের সঙ্গে ইংরেজিতে বাতচিত করার জন্য কিছু ছেলেপুলেও আছে, যারা ব্যবসায়ীদের হয়ে কাজ করে।

বঙ্গবাজারের প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কারণ, সেখানে একটু কম দামে জিনিস পাওয়া যায় ঢাকার অন্য মার্কেটের তুলনায়।

কিন্তু ৪ এপ্রিল ভোরের এক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সব। চার শ বছরের পুরোনো এই রাজধানী শহরের একটি পুরোনো বাজার ভস্মীভূত হলো। সারা দিন ধরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা, যাঁদের প্রধান কার্যালয় বঙ্গবাজার থেকে কুলিফেলা দূরত্বে, চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিশেষ কিছু রক্ষা করতে পারলেন না। হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টারে করে বালতি ভরে পানি আনা হলো! পানির কাছে একসময় আগুনের পরাজয় ঘটল, কিন্তু হেরে যাওয়ার আগে আগুন রেখে গেল কেবল পোশাকের পোড়া স্তূপ। মালামালে পূর্ণ বঙ্গবাজারের পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে নিশ্চিহ্ন হলো।

আরও পড়ুন

চার-পাঁচটি দিন ধরে আমরা ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কান্না দেখলাম, শুনলাম। এর মধ্যে আবার মালামাল লুটও হলো। আমরা সবই পারি! আমাদের ক্রিকেট ও বিনোদনজগতের কয়েকজন তারকা তাঁদের জন্য সহায়তায় এগিয়ে এলেন। সহায়তার পরিমাণ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে প্রচুর বিবাদ-বিসংবাদ ঘটল। দেশের বড় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিছু পোড়া কাপড় কিনে নিল, সেগুলোকেই তারকাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করল সেই টাকা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবে বলে। হিজড়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নগদ ২০ লাখ টাকা দেওয়া হলো। এর বাইরেও কিছু সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিছু অনুদান দেওয়া হলো। প্রবাসীদের কাছ থেকেও কিছু এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও অনুদান দেওয়ার ঘোষণা আছে।

প্রকৃতপক্ষে দান-অনুদানের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা নৈতিক ও ধর্মীয়—সবদিক থেকেই অনুচিত। সংকটের সময় প্রতিটি আধুলির, প্রতিটি দানার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। আর কে কতটা দান করবে, এটা তার ব্যাপার। এখানে অন্যের কথা বলার কিছু নেই।

আরও পড়ুন
আপনি যদি বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কেনাকাটা করেন, এতে তাঁদের সব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, তা নয়। যে ক্ষতি তাঁদের হয়েছে, তা কোনো দিন পোষাবে কি না, সন্দেহ। কিন্তু তাঁদের কাছে গেলে, কেনাকাটা করলে, তাঁরা উৎসাহিত হবেন, মানসিক শক্তি পাবেন, যা এ মুহূর্তে তাঁদের খুব দরকার।

২.

পবিত্র ঈদুল ফিতর আসতে আর বাকি নেই। বাংলাদেশে প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল ফিতর একটি। এরই মধ্যে দেশে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে। অপর দিকে চোখ মুছে, কান্না চেপে রেখে বঙ্গবাজারের কিছু ব্যবসায়ী চৌকি বিছিয়ে সেখানে ‘ব্যবসা’ শুরু করেছেন। কারও হয়তো গুদামে কিছু মালামাল ছিল, কেউ হয়তো কারখানা থেকে কিছু এনেছেন। আপাতত ঈদ পর্যন্ত চৌকি বিছিয়ে ‘ব্যবসা’ চলবে। ঈদের পরে পরবর্তী করণীয় ঠিক হবে, এমন ঘোষণা এসেছে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনারা (রাজধানীবাসী) যদি কেউ বঙ্গবাজারে গিয়ে থাকেন, কিংবা টেলিভিশনে বা খবরের কাগজে সেখানকার ভিডিও বা ছবি দেখে থাকেন, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, সেখানে ব্যবসা করা আসলে কতটা কঠিন।

একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, ৪০/৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুনের হলকা এসে যেন চোখমুখে লাগছে। আবার তাঁরা যে চৌকিতে বসেছেন, সেই বালুমাটির নিচ থেকেও আসছে প্রচণ্ড গরম। কিছু ব্যবসায়ী কেবল চৌকির ওপরে ছাতা বসাতে পেরেছেন। আর অন্যরা খোলা আকাশের নিচে লু হাওয়ার মধ্যেই চৌকি পেতে বসে আছেন ক্রেতার জন্য। রোদ ঠেকাতে অন্তত একটা শামিয়ানা টানানোর ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। আশা করি, মার্কেট কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে তা করবে। অবশ্য শুক্রবার অনেকেই ছাতা বসাতে পেরেছেন। দোকান মালিক সমিতি এ বিষয়ে কাজ করছে।

আরও পড়ুন

৩.

এমন গরমের মধ্যেও কিছু মানুষ বঙ্গবাজারে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটা, দুটি আইটেম কেনার চেষ্টা করছেন। এসব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁরাই প্রকৃত মানবতার পক্ষে কাজ করছেন।

ঈদের কেনাকাটা জোরদারভাবে শুরু হয়ে গেছে। নামীদামি শপিং মলে, মার্কেটে বেজায় ভিড়। মানুষ পছন্দ করছেন, ব্যাগে ভরছেন, টাকা দিচ্ছেন, বের হচ্ছেন। দেশের কিছু মানুষের কাছে বিপুল টাকাকড়ি জমা হয়েছে। যেকোনো উৎসবের সময় তাঁরা হাত খুলে খরচ করছেন। মনেই হবে না, দেশে কোনো অর্থনৈতিক সংকট আছে। তবে কে কতটা কেনাকাটা করবেন, এটা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার।

একটিই কেবল নিবেদন, নগরবাসীদের মধ্যে যাঁরা ঈদের কেনাকাটা করছেন, তাঁদের কেউ কেউ যদি বঙ্গবাজারে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করতেন, তাহলে ভালো হতো। অবশ্য এখন যাঁরা চৌকি বিছিয়ে বসেছেন, তাঁদের কাছে সব ধরনের আইটেম আছে, তা নয়। একজন ব্যবসায়ী তা-ই বলছিলেন। তারপরও যা আছে, যদি চাহিদা থাকে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু কেনা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

আপনি যদি বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু কেনাকাটা করেন, এতে তাঁদের সব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, তা নয়। যে ক্ষতি তাঁদের হয়েছে, তা কোনো দিন পোষাবে কি না, সন্দেহ। কিন্তু তাঁদের কাছে গেলে, কেনাকাটা করলে, তাঁরা উৎসাহিত হবেন, মানসিক শক্তি পাবেন, যা এ মুহূর্তে তাঁদের খুব দরকার।

কেবল বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা নন, তাঁরা নারায়ণগঞ্জসহ যেসব কারখানা থেকে মালামাল এনেছেন, সেসব কারখানার মালিকেরাও বড় ক্ষতির মুখে রয়েছেন। বাজারে তাঁদের বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা কিছু বেচাকেনা করলে কারখানার মালিকদেরও কিছু শোধ করতে পারবেন।

বিপদে মানুষের পাশে থাকাই প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয়। আমরা কি বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য প্রস্তুত আছি?

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    [email protected]