কিছুদিন আগে ঋণ শ্রেণীকরণের আন্তর্জাতিক মান পুনঃস্থাপন করা হলো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পাঠকদের অনেকেরই স্মরণে আসতে পারে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরপরই তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না।
এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য নানা কায়দা করেছিলেন তিনি। শর্ত শিথিল করে ও সংজ্ঞা বদলে দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের পূর্ণ সহায়তা দিয়েছিলেন হিসাববিজ্ঞানী এই মন্ত্রী। পরিসংখ্যান ও শতকরা হিসাবের মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণের হার বাড়েনি বটে; কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে খেলাপি তোষণের সেসব ব্যবস্থা।
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার চার মাসের মাথায় খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার জন্য ঋণ শ্রেণীকরণের পদ্ধতি পাল্টে দেওয়া হয়। সে বছরের (২০১৯) এপ্রিল মাসে জারিকৃত নতুন বিধান অনুযায়ী মেয়াদি ঋণ (টার্ম লোন) ছাড়া অন্য যেকোনো ঋণ বা কিস্তি পরিশোধ করা না হলে নির্দিষ্ট তারিখের পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে। এসব ঋণ ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে ‘নিম্নমান’ (সাব-স্ট্যান্ডার্ড), ৯ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত ‘সন্দেহজনক’ এবং ১২ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে ক্ষতিজনক (ব্যাড/লস) হিসেবে শ্রেণীকৃত হবে। আগের নীতিমালায় সব ধরনের ঋণ শ্রেণীকরণ হতো আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার যথাক্রমে ৩, ৬ ও ১২ মাস পর।
সার্কুলারের প্রথম অনুচ্ছেদ পড়ে মনে হতে পারে নীতিমালাটি বেশ কঠোর। কারণ, ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ পার হওয়ার পরই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে সেটা। কিন্তু পরের শর্তটি পড়লে খেলাপি তোষণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই শর্ত মোতাবেক কেবল মেয়াদি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হবে কিস্তি পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখের ছয় মাস পর। এতে মেয়াদি ঋণ গ্রাহকেরা ছয় মাসের স্বস্তি পেলেন, কিন্তু অস্বস্তিতে পড়লেন ব্যাংকাররা। পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাস তাদের খেলাপি বলে চিহ্নিত করাই যাবে না। এই সংজ্ঞায় খেলাপি হওয়ার ৯ মাস পার হওয়ার পরই সেই ঋণকে ‘নিম্নমান’ হিসেবে গণ্য করা যাবে। অর্থাৎ, একটি মেয়াদি ঋণের কিস্তি বা মূল ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখের ১৫ মাস পর সেটি ‘নিম্নমান’ হিসেবে শ্রেণীকৃত হবে।
হিসাবের এই শুভংকরের ফাঁকি বুঝতে পেরেছিলেন কেবল ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। এই ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি মেয়াদি ঋণগ্রহীতারাও সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে মূল লক্ষ্য ছিল বড় খেলাপিদের সুযোগ দেওয়া। কারণ, খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায়ের ওপর নজরদারি করা ব্যাংকের জন্য সহজ এবং কিস্তি খেলাপ লুকিয়ে রাখা কঠিন। অন্য ধরনের ঋণ (যেমন ওভারড্রাফটের মতো চলমান ঋণ) পরিশোধের কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই। কারণ, এখানে কোনো কিস্তি থাকে না। এ ছাড়া চলমান ঋণ আটকে গেলে সেটাকেও মেয়াদি ঋণে রূপান্তরিত করা হয়। বড় গ্রাহকেরা তাঁদের ঋণের একটা বড় অংশ মেয়াদি ঋণ হিসেবে নেন কলকারখানা ভবন ইত্যাদি বাবদ। সুতরাং সময়ানুবর্তী কিস্তি খেলাপের কারণে তাদের ঋণের বড় অংশ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়তে পারে। কারণেই এ ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছিল।
সরকার পরিবর্তনের পর সংশ্লিষ্ট সব মহলের আশা খেলাপি তোষণ, প্রভাবশালী খেলাপিদের দৌরাত্ম্য, খেলাপি ঋণ আদায়ে গড়িমসি—এসব উপসর্গ দূর হবে। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। বিগত সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাংক খাতে যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে সারিয়ে তোলার জন্য দরকার হবে সব মহল থেকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা।
এই নীতিমালা পরিবর্তনের পরও বছর শেষে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে গেলে অর্থমন্ত্রী ১৯৯১ সালে মোট ব্যাংক ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ৫ হাজার কোটি টাকার দৃষ্টান্ত দেখান, যার হার ২৬ শতাংশ। তাঁর যুক্তিতে পরের ২৮ বছরে মোট ঋণ ৯ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ১২ শতাংশ। সাদাচোখে মনে হয় খেলাপির হার কমেছে। কিন্তু শতকরা হিসাবের কারসাজিটা বোঝা যায় একটু তলিয়ে দেখলে। খেলাপি হওয়ার মেয়াদ শিথিল করা কিংবা মোট ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে দেওয়া—এই দুই পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের শতকরা হার কমানো যায়। তবে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায় করা। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় ও অভিজ্ঞতায় তা সবচেয়ে দুরূহ কাজ। তাই খেলাপি ঋণের হার বাড়তে না দেওয়ার জন্য সহজতম দুটো রাস্তাই গ্রহণ করা হয়েছিল তখন।
এই সময় অর্থমন্ত্রীর আরেকটি অভিনব তত্ত্ব ছিল যে আমাদের ঋণে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আরোপ করা হয় বলে সুদের হার অনেক বেশি আসে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে না। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ার কারণেই সুদের হার বেশি রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। প্রভাবশালীদের ঋণ পরিশোধে অনীহা বিষয়ে নজিরবিহীনভাবে এই শ্রেণির পক্ষে অবস্থান নিয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশে ব্যবসায়ী প্রভাবশালীরা অর্থনীতির ৮২ শতাংশ। তাঁদের বাদ দিয়ে ১৮ শতাংশ নিয়ে অর্থনীতি সাজানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ, প্রভাবশালীদের ব্যাংকঋণ পরিশোধের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
প্রভাবশালীদের তোষণ ছিল আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিচিত আচরণ। ব্যাংকমালিকদের চাপে ২০০৯ সালে একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা ২ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪। তাঁদের পর্ষদে থাকার মেয়াদও ৬ থেকে ৯ বছরে উন্নীত করা হয়। বড় খেলাপিদের জন্য ২০১৫ সালে এক অভিনব সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণকে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করার বিধানের মধ্য দিয়ে। এই সুযোগে ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ থেকে
সরিয়ে ফেলা হলেও প্রয়োজনীয় শর্তগুলো শেষ পর্যন্ত পালন করতে পারেনি এসব প্রতিষ্ঠান।
২০১৮ সালে ব্যাংকিং ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ঘটনায় ব্যাংকমালিকদের চাপে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই নগদ জমার হার বাজারে অর্থ সরবরাহ, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। একই গোষ্ঠীর চাপের মুখে বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি তহবিলের ২৫ শতাংশ গচ্ছিত রাখার হার বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল, যার বিরাট অংশ এখন কয়েকটি অসচ্ছল ব্যাংকে আটকে গেছে। তখনকার অর্থমন্ত্রী বয়োবৃদ্ধ এ এম এ মুহিতকেও ব্যাংকমালিকদের কাছে বড়ই অসহায় ও দুর্বল মনে হয়েছিল সে সময়।
২০১৯ সালে ২ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট, ১০ বছরে পরিশোধ, ক্ষেত্রবিশেষে কস্ট অব ফান্ড কিংবা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপসহ বিভিন্ন লোভনীয় শর্তে পুনঃ তফসিল এবং এককালীন নিষ্ক্রান্ত (এক্সিট) হওয়ার আরেকটি সুযোগ দেওয়া হয়েছিল খেলাপিদের। তারপরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। ২০২২ সালে আরও একবার ৫০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপিদের ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ২৯ বছরের মেয়াদে পুনঃ তফসিল করার সুযোগ–সংবলিত তোষণমূলক নীতিমালা জারি করা হয়। এই উদ্যোগ কতখানি সফল হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ নেই।
ব্যাংকমালিকদের চাপে (২০২৩) আবারও পরিচালকদের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ১২ বছর। আগের নীতিমালা শিথিল করে কোনো শিল্প বা ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সুবিধা অবারিত করে দেওয়া হয়।
বহু বছরের গড়িমসি ও অনিচ্ছার পর ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এই আইনের ভিত্তিতে কোনো খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে যে কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা কতখানি সফলভাবে আমাদের ব্যাংকগুলো করতে পারবে তা নিশ্চিত না। এ বিষয়ে নীতিমালা জারির পর এখন পর্যন্ত কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই।
সরকার পরিবর্তনের পর সংশ্লিষ্ট সব মহলের আশা খেলাপি তোষণ, প্রভাবশালী খেলাপিদের দৌরাত্ম্য, খেলাপি ঋণ আদায়ে গড়িমসি—এসব উপসর্গ দূর হবে। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। বিগত সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাংক খাতে যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে সারিয়ে তোলার জন্য দরকার হবে সব মহল থেকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা।
● ফারুক মঈনউদ্দীন ব্যাংকার ও লেখক