হেনরি কিসিঞ্জারের নিষ্ঠুর একটি পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘আমেরিকার শত্রু হওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়াটা মারাত্মক।’ তাঁর সেই বক্তব্যটি আজকের দিনে আরও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে। বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রদের জোট অটুট থাকবে, ধারণাটি একসময় বদ্ধমূল ছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক যে শর্তাধীন, সেটা ক্রমে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতিপথ বিবেচনায় নিলে এর থেকে বাস্তব উদাহরণ আর কী হতে পারে।
দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল প্রভাবশালী একটি লবির ওপর ভর করে ওয়াশিংটনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, একটা দারুণ সুসম্পর্ক উপভোগ করে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যেখানে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের প্রতি প্রশ্নহীন সমর্থন দেওয়ার অবস্থানে ফাটল ধরেছে।
ইসরায়েল ও ওয়াশিংটনে সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। এর জন্য আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক আফেয়ার্স কমিটি এবং একটি ইহুদি লবি বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এই শক্তি ইসরায়েলের জন্য প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করে আসছে। জাতিসংঘে তারা ইসরায়েলকে কূটনৈতিক দায়মুক্তি দিচ্ছে। ইসরায়েলের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন তারা জুগিয়ে আসছে।
এই প্রভাব শুধু লবি বা তদবিরের ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমেরিকান ইহুদিদের সঙ্গে গভীর ঐক্যের সম্পর্কের মধ্যেও নিহিত। অনেকে ইসরায়েলকে তাদের সাংস্কৃতিক অভয়ারণ্য বলে মনে করে।
আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, বিশেষ করে প্রগতিশীল অংশের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো প্রজন্ম যেখানে ইসরায়েলকে গণতান্ত্রিক মিত্র বলে মনে করে, সেখানে তরুণদের মধ্যে এই মনোভাব বাড়ছে যে ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। গাজার ধ্বংসযজ্ঞের ছবি যেমন বোমায় বিধ্বস্ত হাসপাতাল, শোকাচ্ছন্ন পরিবার, ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা শিশুদের মরদেহের ছবি ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আমেরিকান ইহুদি যারা একসময় ইসরায়েলি স্বার্থের কট্টর রক্ষক, তারা নিজেরাই নৈতিক প্রশ্নের মুখে পড়েছেন।
জ্যুইস ভয়েস ফর পিস ও ইফনটনাউ-এর মতো সংগঠনের ডাকা প্রতিবাদে হাজার হাজার প্রতিবাদকারী সমবেত হয়েছেন। তারা ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। ইসরায়েল প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলের আহ্বান জানিয়েছেন।
২০২৩ সালে পিউ রিসার্চের জরিপে বেরিয়ে আসে, ৪০ বছরের নিচে আমেরিকান ইহুদিদের ৫২ শতাংশ বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল সরকার বর্ণবাদী অপরাধের জন্য দায়ী। এটা নিঃসন্দেহে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন।
এদিকে ইসরায়েলের নেতারা এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছেন। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর ডানপন্থী জোট তাঁদের নিজেদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে খাটো করে ফেলার চেষ্টা করছে। আমেরিকান ইহুদিদের সমালোচনা করে তাঁরা বলেছেন, ‘তাঁরা আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজনগুলোকে বোঝে না।’ এই অবস্থানের কারণে ইসরায়েল সরকার উদারপন্থীদের মধ্যে মিত্র হারাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে আমেরিকান ও ইসরায়েলি ইহুদিদের মধ্যে বিভক্তি প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিয়েছে। আমেরিকান ইহুদিদের বড় একটা অংশ প্রগতিশীল, সেক্যুলার। তারা বহুত্ববাদ ও সমতায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে ইসরায়েলি ইহুদি, সুনির্দিষ্টভাবে নেতানিয়াহুর অধীনে ইহুদিরা জাতিপরিচয়কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের দিকে ক্রমাগত ঝুঁকে পড়ছে। তারা ফিলিস্তিনিদের বৈধ অধিকারগুলোকে ইসরায়েলি নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে।
২০২১ সালে গাজা যুদ্ধের সময় এই সংঘাত বিস্ফোরণের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসরায়েলের বোমাবর্ষণকে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে আত্মরক্ষা বলে প্রচার করা হচ্ছিল। অন্যদিকে আমেরিকান ইহুদিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেসে যাচ্ছিল ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার তথ্যপ্রমাণ দিয়ে।
এর প্রতিক্রিয়ার পরিণতি ছিল বিষাক্ত। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আমেরিকান ইহুদিদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক কৌশলপ্রণেতা স্টিভ ব্যানন, প্রগতিশীল ইহুদিদের ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে খারাপ শত্রুর’ তকমা দেন। এটি একটি তিক্ত সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। তা হলো, ইসরায়েল সরকার ভিন্নমতকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে।
আমেরিকার তরুণ ইহুদিরা তাঁদের পূবপুরুষদের ট্রমা ও নিপীড়নের ইতিহাসকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির সঙ্গে একই সমান্তরালে রেখে বুঝতে চেষ্টা করছেন। ২০২২ সালের একটি জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৩৫ বছরের নিচের আমেরিকান ইহুদিদের ২৫ শতাংশ ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করেন। এটা কল্পনা করাও একসময় অসম্ভব ছিল।
নেতানিয়াহুর নীতিই এই সংকটকে ত্বরান্বিত করেছে। অতি গোঁড়া দলগুলোর ওপর নেতারনিয়াহুর নির্ভরতা ভিন্নমতালম্বী ইহুদিদের প্রান্তিক করে ফেলেছে। বিবাহের ক্ষেত্রে ও রক্ষণশীল আইনের কারণে তাঁরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে সামরিক পথ বেছে নেওয়ায় তাঁরা হতাশ হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেনকে পরিত্যাগ ইসরায়েলের জন্য একটি বড় সতর্কতা। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে বলিয়ান ইউক্রেন এখন ইউরোপের কাছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভিক্ষা করছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে নিয়ে একসময় মার্কিন কংগ্রেস উদ্যাপন করেছে। কিন্তু একটি লেনদেনের জোটের বিপদ কী হতে পারে, সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।
ইসরায়েলও এ থেকে সুরক্ষিত নয়। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথমে’ নীতি নেতানিয়াহুর প্রতি যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছে। কিন্তু আনুগত্য শেষ পর্যন্ত উপযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মাগা (আমেরিকাকে আবারও মহান করা) প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে ইসরায়েলও তাদের খাতা থেকে বাদ পড়তে পারে।
মোহাম্মদ মাকরাম বালাভি, লিগ অব পার্লামেন্টারিয়ানস ফর আল-কুদসের মহাপরিচালক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত