ট্যাগের মহিমা: ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’

কাউকে ভাতে কিংবা হাতে মারতে জুতসই অজুহাত লাগে। অজুহাত পয়দায় ময়দা ছড়ানো ময়দানে সুচ খোঁজার কায়দায় নিখুঁত খুঁত খুঁজে বের করার দরকার হয় না। শুধু তার মান ইজ্জতে বেতমিজ-বজ্জাতের একটা তকমা আঁটতে হয়। একটা ক্রিমিনালের লেবেল সাঁটতে হয়।

তকমাটা ভালোমতো এঁটে গেলে, লেবেলটা ভালোভাবে সেঁটে গেলে, সেই লোক ফায়ার খাওয়া ফুটো টায়ারের মতো চুপসে হায়ার থেকে লোয়ার লেভেলে নেমে আসে। নামী দামি ভূস্বামীও তখন দাগি আসামির মতো কুঁকড়ে যায়।

সোশ্যাল স্টিগমা, মানে সামাজিক কালিমায় ক্লিষ্ট লোকটিকে তখন মা-খালাম্মা, মাসি-পিসি পর্যন্ত মিছেমিছি ছিঃ ছিঃ করে। বন্ধুবান্ধব বলে, ‘তলে তলে তুই এত বজ্জাত, তাতো জানতাম না! যা সর, সাইড হ!’ আপন ভাইটি থেকে গোটা সোসাইটি তখন গাইড না দিয়ে সাইড করে ফেলে। মনের মানুষটিও দেখা না দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ায় সে একা হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

সামাজিক পরিসরে ভালোবাসা না পাওয়া কোণঠাসা লোককে তখন চাইলে দিনে-রাতে, হাতে-ভাতে, যখন যেভাবে চাও মারতে পার। কেউ তখন আর ঠেকাতে আসবে না। কারণ ক্রাইম করুক আর না করুক, সেই লোক তখন সোশ্যালি ক্রিমিনাল। তাকে মারাটাই তখন মবের জাস্টিস। মব জাস্টিসের মধ্যেই তখন ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’এর ফয়সালা।

তো, তকমা আঁটা বা লেবেল সাঁটা বা দাগিয়ে দেওয়ার ভদ্দরলোকি নাম ‘ট্যাগ লাগানো’। এই ট্যাগ শপিং ব্যাগের প্রাইস ট্যাগ না; ফেসবুকের হ্যাশট্যাগও না। এই ট্যাগ পদস্থকে অপদস্থ করার টিপিক্যাল সাইকি।

অন্যের জন্য এক হাতে কালির ডিব্বা, আরেক হাতে ‘আইক্ক্যা’ বাঁশ রাখা যদিও বাঙালির সহজাত স্বভাব; তবু ট্যাগ লাগিয়ে অন্যকে টেনে নামানোর খেলায় ‘আত্মঘাতী বাঙালির’ও অনেক ওপরে অনেক লোক আছে।

ফেসবুকে ফ্যাসিবাদী নেতাদের উদ্দেশে যাঁরা এক সময় ‘দোসর ওগো, দোসর আমার, দাওনা দেখা’ টাইপের স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, কিংবা বর্তমানে বিতাড়িত নেতা-লেখক-কবির সঙ্গে চা-টোস্ট খাওয়ার ছবি তুলে পোস্ট করেছিলেন, তাঁদের এখন ‘রোস্ট’ করা হচ্ছে। সংক্ষেপে তাদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনালি সবচেয়ে পপুলার ট্যাগের নাম ছিল ‘টেররিস্ট’। বুদ্ধের মতো শান্তির কথা বলে যুদ্ধের মতো অশান্তি ছড়ানো প্রেসিডেন্ট বুশ ছিলেন এর হোলসেলার। আরব থেকে আফগানিস্তান; আমেরিকা থেকে পাকিস্তান; যখন যেখানে যাকে মারার দরকার হয়েছে, সেখানেই তাৎক্ষণিক যার তার গায়ে তিনি ‘টেররিস্ট’ ট্যাগ ট্যাটুর মতো লাগিয়ে দিয়েছেন।

সেই বুশের রিপাবলিকান পার্টির জন ম্যাককেইনের সঙ্গে যে বছর ওবামার প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিয়ে টাইট একটা ফাইট হয়, সে বছর ওবামার বাবা-মার বংশ পরিচয় এবং তাঁর মিডল নেম ‘হুসেইন’কে সামনে এনে রিপাবলিকানরা তাঁর গায়ে ‘আরব’ ট্যাগ লাগানোরও চেষ্টা করেছিল।

সেই ওবামাও বুশের ‘যুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ ঘরানার ট্যাগমন্ত্রধ্বনি মুখস্থ করেছিলেন। ট্রাম্প তা ঠোঁটস্থ করেছিলেন। বাইডেনও বাদ যাননি। সাদ্দাম থেকে গাদ্দাফি কেউ ‘টেররিস্ট’ ট্যাগ থেকে রেহাই পাননি।

‘টেররিস্ট’ ট্যাগ বাংলায় অনূদিত ভঙ্গিতে ‘জঙ্গি’ হয়েছে। দেশে জঙ্গি ছিল। এখনো হয়তো আছে। কিন্তু হরেদরে মানুষ ধরে জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে তাঁদের নিয়ে মাঝ রাত্তিরে অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া; সেখানে আগে থেকে ওত পেতে থাকা জঙ্গিদের দিক থেকে গুলি ছুটে আসা এবং যথারীতি সঙ্গী জঙ্গিদের গুলিতে পুলিশের সঙ্গে থাকা জঙ্গির মারা যাওয়া বিষয়ক অল্পস্বল্প গল্প শুনতে শুনতে এবং সেসব গল্পের সংখ্যা গুনতে গুনতে আমরা ক্লান্ত হয়েছি।

আমরা ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’, ‘শাহবাগি’, ‘হেফাজতি’, ‘র-এর এজেন্ট’, ‘ফ্যাসিবাদী’-ইত্যাকার বিচিত্র ট্যাগের বহুল ব্যবহার দেখেছি। ‘পাকিস্তানের দালাল’-কে সংক্ষেপে ‘পাদা’ এবং ‘ভারতের দালাল’-কে সংক্ষেপে ‘ভাদা’ হিসেবে ট্যাগায়িত করা দেখেছি। কিন্তু কেউ কাউকে কোনোদিন ‘বাংলাদেশের দালাল’ বা ‘বাদা’ হিসেবে ট্যাগায়িত করেছে বলে শুনিনি।

২০১৮ সালে যুক্তিসংগত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের দাবি উড়িয়ে দিয়ে রাজপথের রাজাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগ দিয়েছিলেন প্রজাতন্ত্রের একজন মন্ত্রী। ২০২৪ সালে সেই একই দাবি তোলা ছাত্রছাত্রীর গায়ে একই ট্যাগ দাগাতে চেয়েছিলেন খোদ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী। এটা সূক্ষ্ম কোনো দুঃখ দেওয়া কথা ছিল না; ছিল রুক্ষ গালি। ভয়ংকর গালি।

অনেক ‘বাচ্চা’ জানে, তার বাবা রাজাকার ছিলেন না, শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যুক্তিসংগত প্রশ্ন তোলায় তাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি খেতে হলো। আমরা এক সাবেক বিচারপতিকে লাইভ টক শো-তে ‘দেশে চার কোটি রাজাকারের বাচ্চা আছে’ বলে উচ্চস্বরে আচ্ছামতো চেঁচাতে শুনেছি এবং তাঁকে সে অনুষ্ঠানেই সঞ্চালক তরণীটিকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিতে দেখেছি।

যে সন্তানের বাবার মামাতো ভাইয়ের খালু শ্বশুরের চাচাতো ভাই টাইপের কোনো আত্মীয় রাজাকার ছিলেন, চাকরিতে নিয়োগের সময় সেই সন্তানকে ‘রাজাকার পরিবারের সন্তান’ সাব্যস্ত করে চাকরি না দেওয়ার কথাও শুনেছি।  

তবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার মুখে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি নতুন ‘বাচ্চাদের’ পক্ষে গেলা সম্ভব হলো না। তারা আন্দোলন করল। সরকার ফেলে দিল। নতুন সরকার গড়ল।
এখন নতুন সময়। এখন ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগের বাজার ভালো না। এখন যে ট্যাগটির ডবল ডিমান্ড, সেটি হলো, ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’।

ফেসবুকে ফ্যাসিবাদী নেতাদের উদ্দেশে যাঁরা এক সময় ‘দোসর ওগো, দোসর আমার, দাওনা দেখা’ টাইপের স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, কিংবা বর্তমানে বিতাড়িত নেতা-লেখক-কবির সঙ্গে চা-টোস্ট খাওয়ার ছবি তুলে পোস্ট করেছিলেন, তাঁদের এখন ‘রোস্ট’ করা হচ্ছে। সংক্ষেপে তাদের ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলা হচ্ছে।

তবে ‘রাজাকারের বাচ্চা’র মতো ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ যখন তখন যার তার গায়ে লাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ভয়ের। কারণ ট্যাগ জিনিসটা আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আক্রমণকারীর হাতে অজুহাত তুলে দেয়। এটা ভয়ের। কারণ ‘ট্যাগানো’ লোক প্রকারে ও সংখ্যায় গোকুলে বাড়ে।

সাধারণত যাঁদের হাতে ক্ষমতা থাকে তাদের ভেতরকার লোকজন ট্যাগ লাগানোর ‘অধিকারী’ হয়ে থাকে। ব্যাগের ভেতর থেকে ট্যাগের বিড়াল বের করে সবেগে আবেগের জল ঘুলিয়ে ঘোলা জলে তারা মাছ ধরে। বুশের মতো ‘হয় তুমি আমাদের, নয়তো সন্ত্রাসবাদীদের’ বলে তারা ভাগের রেখা টানে। কেউ বেসুরো হলেই অসুরের ট্যাগ তাঁর গায়ে লাগায়।

নতুন বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আছে। তাই বলে যখন তখন যাকে তাকে এই বলে ট্যাগ লাগানো ফ্যাসিবাদেরই লক্ষ্মণ। তাই ট্যাগবাদ ত্যাগ করতে হবে।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]