গণপরিষদ নির্বাচন নাকি সংসদ নির্বাচন: বিতর্কটা আসলে কোথায়?

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে অন্তত চারটি কমিশন—সংবিধান, নির্বাচন, দুদক ও পুলিশ—তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে। বাকি সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব এ মাসের শেষে এবং আগামী মাসের মাঝামাঝির মধ্যে পাওয়া যাবে।

সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করার কালে প্রধান উপদেষ্টা দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, এ সংস্কার প্রস্তাবগুলো থেকে গণ–অভ্যুত্থানের সনদ প্রণয়ন করা হবে। সব দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রণীত সনদে দলগুলোর স্বাক্ষর রাখা হবে। অর্থাৎ ইউনূস সরকারের রেখে যাওয়া কিছু সংস্কার দলগুলো করতে বাধ্য থাকবে। নির্বাচন আসুক আর যা-ই ঘটুক, সনদ থেকে সরা যাবে না। সংস্কার বাস্তবায়ন না করা হবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

কিছু আশু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বর্তমান সরকারকেই করতে হবে। কারণ, গণ–অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান নির্মাণই জন–আকাঙ্ক্ষা। যেনতেন কায়দায় একটা নির্বাচন ঘোষণা করলে হাজারো শহীদের রক্তের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রী’ ছাড়া আর কিছু জনগণকে দিতে সক্ষম হবে না। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে বারবার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এত দিন ‘যৌক্তিক সময়ে’ নির্বাচন চাইলেও কিছুদিন ধরে বিএনপি এ বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন চেয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিএনপির কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা সরকারের কাছে সংস্কারের রোডম্যাপ চাইবে। অর্থাৎ কী প্রক্রিয়ায় কারা কতটুকু সংস্কার করবে, তা খোলাসা করার দাবি তারা জানাবে। তবে বিএনপিকে কেবল নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের দিক থেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় (সংস্কার সাপেক্ষে ২০২৬ সালের জুন বা জুলাই, সংস্কার ছাড়া এ বছরের ডিসেম্বর) সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপিকে তাতে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে না। 

কেবল সংবিধান ছাড়া পুলিশ, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ গৃহীত সব সংস্কার করার ম্যান্ডেটই বর্তমান সরকারের রয়েছে। সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংস্কারের ক্ষেত্রে গণপরিষদ নির্বাচন আহ্বান করাই যৌক্তিক। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ধারণা, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে সংবিধান সংস্কার করবে, বর্তমান সরকারের সেই ম্যান্ডেট নেই। আমরাও মনে করি, সংবিধান সংস্কার বা প্রণয়নের ম্যান্ডেট এই সরকারের নেই। তবে সেই ম্যান্ডেট পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছেও নেই।

কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের অধীন গঠিত পরবর্তী নির্বাচিত সরকার মূলত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার তল্পিবাহকই হবে। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গৃহীত এবং গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত সংবিধানের অধীন পরবর্তী নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ নির্বাচিত সরকারের কাছে সংবিধান সংস্কারের ম্যান্ডেট রয়েছে, পদ্ধতিগত বাস্তবতা এমন ধারণার ঠিক উল্টো। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকেই বরং নতুন সংবিধানের কাছ থেকে আইন প্রণয়নের ম্যান্ডেট অর্জন করতে হবে। 

আরও পড়ুন

সংবিধান সংস্কার কমিশন বেশ কিছু ইতিবাচক সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে। ক্ষমতাকাঠামোতে ভারসাম্য আনা, একক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা যেন কুক্ষিগত না হয়, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র যেন রক্ষিত হয়; কমিশনের প্রস্তাবে জনপরিসরে জারি থাকা এই উদ্বেগগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিতে সংবিধান সংস্কার কিংবা প্রণীত হবে, সে বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে কোনো প্রস্তাব লক্ষ করা যায়নি। অথচ সংস্কারকে টেকসই ও কার্যকর করতে পদ্ধতির প্রশ্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণত জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলকে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করে। 

অন্যদিকে যদি কোনো দেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে রাষ্ট্র সংস্কার, মেরামত বা পুনর্গঠন করতে হবে, সে ক্ষেত্রে সংবিধান সভা অথবা গণপরিষদ নির্বাচন আহ্বান করতে হয়। নির্বাচিত গণপরিষদ তর্ক ও বাহাসের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনগণের সামনে একটি খসড়া সংবিধান পেশ করে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ ওই সংবিধান অনুমোদন করার পর রাষ্ট্র গঠনের কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। সরকার পরিচালনার নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের কর্মপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। সামষ্টিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় দ্বারাই জনগণ রাষ্ট্র গঠন করে। জনগণ নিজেই তার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের হেফাজত করে, প্রয়োজনে পরিবর্তন করে। অন্যদিকে সরকার পরিচালনার স্বার্থে জনগণ সংসদে তার প্রতিনিধি পাঠায়। জনগণের প্রতিনিধি জনগণের খোদ ইচ্ছাকে বদলে দিতে পারে না। বদলের প্রয়োজন হলে জনগণ নিজেই উদ্যোগ নেয়।

সাধারণত বড় কোনো আন্দোলন বা গণ–অভ্যুত্থানের পর এ ধরনের মুহূর্ত হাজির হয়। যদি প্রতীয়মান হয় যে বিদ্যমান সংবিধান গণ–অভিপ্রায়ের ধারক হতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা বিদ্যমান সংবিধানের মধ্য দিয়ে আর জন–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে না, তখন সংবিধান প্রণয়ন অথবা নিদেনপক্ষে সংস্কারের বিকল্প থাকে না। নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের এ মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তত দুবার (১৯৭২ ও ১৯৯১ সালে) এই ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর পিছুটান ও রক্ষণশীলতার কারণে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রীকরণের আবশ্যিক কাজ হাতে নেওয়া যায়নি।

চব্বিশের অভ্যুত্থানের তাৎপর্য তাই অপরিসীম। নয়া উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় উন্নয়নতন্ত্র আর চেতনার মহাবয়ানকে আশ্রয় করে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ বিরাজনীতিকরণ ও গণতন্ত্রহীনতার শাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতিতে কেটেছে জনজীবন। গত জানুয়ারির আগে রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে ছিল। ফ্যাসিবাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে লাভ নেই, এ নির্মম সত্য তাঁরা জানেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। 

তবু বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওই আন্দোলন দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছিল। এখন অনেকেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই–সংগ্রামের কথা বলছেন। বিগত ১৬ বছরে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আওয়ামী লীগ অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে, এ কথা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, গত জানুয়ারিতে গায়ের জোরে ডামি নির্বাচন করে ফেলার পর রাজনৈতিক পরিসরে নৈরাশ্য ও হতাশাই লক্ষ করা গেছে। শিগগিরই আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটবে, অতি আশাবাদী মানুষও তা কল্পনা করতে পারেনি।

ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানকে এ বাস্তবতার নিরিখেই বোঝা দরকার। অন্যত্র লিখেছিলাম ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির দুটি প্যারাডাইম ছিল—যথাক্রমে জানুয়ারি ও জুলাই প্যারাডাইম। জানুয়ারির নির্বাচনবাদী প্যারাডাইম ব্যর্থ হওয়ার বাস্তবতায় জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান প্যারাডাইমের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তা বিজয়ী হয়েছে। অর্থাৎ এক-এগারোর সম্প্রসারণ আওয়ামী নব্য বাকশালী রেজিমের পতন ঘটিয়ে জনগণের রাজনীতি ফিরে এসেছে। কোনো কোনো ভাবুক এ ধারাকে ‘গণরাজনৈতিক ধারা’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, যা সংকীর্ণ দলীয় নির্বাচনবাদী রাজনৈতিক ধারার তুলনায় মৌলিকভাবে আলাদা।

এ ধারার রাজনীতির রূপকাঠামো জনগণকে স্রেফ পাঁচ বছরে একবার ভোটের উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করে না। জনগণের সক্রিয় নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার রাজনৈতিক প্রকল্প বেগবান করে। দলীয় রাজনীতির চেয়ে ভিন্ন এ রাজনীতির ভাব ও ভাষা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ‘মাইনাস টু’র আশঙ্কায় কাতর। অথচ বিরাজনৈতিক বাকশালী শাসনের পটভূমিতে জুলাই অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক বিপ্লবী রাজনীতির প্রত্যাবর্তন। জুলাই প্যারাডাইমকে সংকীর্ণ জানুয়ারির প্যারাডাইমে সংকুচিত করা মূলত ইতিহাসের কাঁটাকে পেছনের দিকে ঘোরানোর রক্ষণশীল প্রচেষ্টা।

অবশ্যই দলীয় নির্বাচনবাদী রাজনীতি থাকবে। তবে রাষ্ট্র গঠন বা সংস্কার না করে সরকার পরিচালনার নির্বাচনের দাবি রক্ষণশীলতারই নামান্তর। এ কারণে সংসদ নির্বাচন নয়, আসন্ন নির্বাচন হওয়া দরকার গণপরিষদ নির্বাচন। তবে সংবিধান প্রণয়নের পর ওই গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে।

বিএনপি এখনো সরকার পরিবর্তনের রাজনীতির প্যারাডাইমে বিরাজ করছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-তরুণ শক্তি ব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে এগোচ্ছে। ব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতির মধ্যে সরকার পরিবর্তনের রাজনীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আছে। অন্যদিকে স্রেফ নির্বাচনবাদী তথা সরকার পরিবর্তনের রাজনীতি আবশ্যিকভাবে ব্যবস্থা পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয় না। শহীদ আসাদ ও নূর হোসেনের আত্মত্যাগ শহীদ আবু সাঈদে এসে পরিণতি পাবে, এটাই চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

সারোয়ার তুষার লেখক ও চিন্তক, যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি