পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম ও টানা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী দুনিয়া তখন দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একটি বলয়ের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অন্য বলয়ের নেতৃত্বে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
নেহরু এই দুটি বলয় থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখার জন্য জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বাংশে সে অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। তিব্বতকে ঘিরে সিআইএ তথা যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার কারণে শেষ পর্যন্ত জোটনিরপেক্ষ নেহরুর পক্ষেও নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হয়নি।
তিব্বতের কথিত শাসক ও ধর্মগুরু তেনজিন গিয়াৎসো (চতুর্দশ দালাই লামা) যখন ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সিতে (নেফা) (বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশ) প্রবেশ করেন এবং পরবর্তী সময়ে ভারতে আশ্রয় নেন, তখন থেকেই বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে ভারতের উষ্ণতায় ভাটা পড়তে শুরু করে।
ব্রিটিশ রাজের নির্ধারিত পশ্চিমের জনসন লাইন এবং পূর্বের ম্যাকমোহন লাইন বলে পরিচিত সীমান্তের ঐতিহাসিক অধিকার নিয়ে একসময়কার ‘হিন্দি-চীনা ভাই ভাই’ সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তা সামরিক সংঘাতের দিকে গড়ায়। উত্তেজনা প্রশমনে ভারতের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও চীনের নেতা চৌ এনলাই বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
১৯৬০ সালে দিল্লি সফরে এসে চৌ এনলাই তিব্বত ইস্যু সামনে এনে দুই দেশের সীমান্ত বিভেদ, বিশেষ করে পশ্চিম সীমান্তের উত্তেজনা কমাতে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়কার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অতি চাহিদার কারণে চৌ এনলাইয়ের প্রস্তাবটি নেহরু নাকচ করতে বাধ্য হন। এর পরে ভারতের কিছু উচ্চাভিলাষী পরামর্শকের কারণে দুদেশের মধ্যে প্রায় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়।
১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এই যুদ্ধে চীন পশ্চিম রণাঙ্গনে আকসাই চীনের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি দখল করে নেয়। একই সঙ্গে তারা পূর্ব সীমান্তে আসামের পূর্ব পর্যন্ত দখল করে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
ভূকৌশলগত কারণে এখন ভারতের প্রয়োজন কথিত চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডরের বিপরীতে আরও সুরক্ষিত বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি করা। এই কাজ তারা দ্রুত শুরু করতে চায়। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের সহযোগিতা আশা করে। সে ক্ষেত্রে পূর্ব সীমান্তে চীন-ভারত সম্ভাব্য সংঘাত বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা শুধু ভূকৌশলবিদদেরই নয়, ভূরাজনীতিবিদদেরও ভেবে দেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ভারতের কাছ থেকে হাতছাড়া হওয়া আকসাই চীন আজও চীনের দখলে রয়েছে। সেখানে দুই দেশের সীমান্তরেখা টানা হয়েছে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের (এলএসি) মাধ্যমে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে ভারতের ব্যাপক পরাজয় শুধু নেহরুর জন্যই নয়, ভারতের জন্য আজ অবধি মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে রয়েছে।
ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে চীন এখনো নিজের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। গত মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওই অঞ্চলে সফর নিয়ে চীন কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য অঞ্চলটি ভারতের নয়, চীনের অংশ।
জবাবে ভারত বলেছে, অরুণাচল প্রদেশটি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০২৩ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে ভারতের উশু দলের ৩ খেলোয়াড়কে (যঁাদের বাড়ি অরুণাচল) চীন ভিসা দেয়নি এবং তার প্রতিবাদে ভারতীয় দল চীন সফর বাতিল করেছিল। খেলোয়াড়দের ভিসা না দেওয়ার মাধ্যমে চীন বোঝাতে চেয়েছে, অরুণাচল তাদের ভূখণ্ড, ভারতের নয়।
১৯৬২ সালের যুদ্ধ থেকে ভারত যে শিক্ষা নিয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলকে ভারত অধিকতর সামরিকায়ন করেছে এবং সেখানে চলাচলের ব্যবস্থা উন্নত করেছে। একই সঙ্গে ভারত শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’–এর প্রতিরক্ষা এবং সরবরাহ লাইনের প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছে। তারপরও এই অঞ্চলই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং চীনের সরাসরি নজরদারির আওতায় রয়েছে। এ কারণে এখানে ভারতের জন্য বিকল্প এবং নিরাপদ আপত্কালীন সরবরাহ পথ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ পথের খোঁজেই এখন ভারতের ভূকৌশলবিদেরা তৎপর হয়ে উঠেছেন।
১৯৬২ চীন-ভারত যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই ভারতীয় সেনাদের ওপর যে বিপর্যয়কর মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়েছিল, সেই চাপের প্রতিফলন এই সময়কার ভারতের বিদেশ ও সামরিক নীতিতেও দেখা যায়। বিষয়টি যে ভারতের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তা ভারতীয় কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদেরাও স্বীকার করেছেন।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় থাকলেও দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ জটিল হতে জটিলতর হচ্ছে। চীন দখলকৃত আকসাই চীন ছাড়াও অরুণাচল ও আসামের কিছু অঞ্চলকে ঐতিহাসিকভাবে তিব্বতের বহিরাংশ বলে দাবি করে।
ঐতিহাসিকভাবে অরুণাচল (একসময়ের ‘নেফা’) ১৯১৪ সালের আগে চীনের অংশ ছিল—এই কথা বেইজিং প্রায়ই দিল্লিকে মনে করিয়ে দেয়। চীন এই প্রদেশের নাম দিয়েছে সিয়াং। একই সঙ্গে চীন এ অঞ্চলের ৩০টি স্থানের ঐতিহাসিক তিব্বতি তথা চীনা নাম দিয়েছে।
এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতেই আমি এই লেখায় ঐতিহাসিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছি।
আমরা জানি, বর্তমানে বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে কোয়াডের উদ্ভব এবং বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে চীনের কাছে এখন দুটি সংবেদনশীল বিষয় রয়েছে। একটি হলো তাইওয়ান, অপরটি তিব্বত।
১৯৭৫ সালে ভারতের সিকিম দখল এবং ভূখণ্ডটিকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পরও ভারত ও চীনের মধ্যে একধরনের অলিখিত বোঝাপড়া ছিল যে তিব্বত এবং তিব্বতে দালাই লামার কথিত কর্তৃত্বের বিষয়টি চাপা থাকবে। অন্তত ১৯৭৯ সালের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফর শেষে তিব্বত নিয়ে টানাপোড়েন অবসানের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল।
১৯৭১ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের মূলে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন নীতি’ গ্রহণ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তিব্বত ও তিব্বতের বহিরাংশকে চীনের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র তিব্বত ইস্যুকে আবার চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। এর ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, ভারতের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর প্রমাণ ২০২০–এর গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারতের সীমিত সংঘাত।
তিব্বতকে ঘিরে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ যে জটিল এবং সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, তা বেশ স্পষ্ট। গত মাসে মার্কিন কংগ্রেসের উভয় দলের ৭ সদস্যের একটি দল ভারত ভ্রমণে গিয়ে ধর্মশালায় গিয়ে দালাই লামা এবং প্রবাসী সরকারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে। মার্কিন প্রতিনিধিরা তিব্বতের নেতাদের হাতে তুলে দেন গত ১২ জুন পাস করা ‘রিসলভ তিব্বত অ্যাক্ট’–এর একটি কপি।
যুক্তরাষ্ট্রের এই আইনের মাধ্যমে দালাই লামার সঙ্গে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন তথা সার্বভৌমত্ব নিয়ে আবার আলোচনার দ্বার উন্মোচন করতে চীনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতের কথিত প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাবে বলেও আইনটিতে বলা আছে। তিব্বত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতির বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন।
এরই মাঝে মার্কিন দলটি গত ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দেখা করে নতুন আইনটির বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেছে। মোদির তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রিত্বের যাত্রার শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত তিব্বত নীতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে ভারতের নতুন উত্তেজনার পথ উন্মুক্ত হলো।
যেহেতু কয়েক বছর ধরে অরুণাচল সীমান্তে উভয় পক্ষ শক্তিমত্তা বাড়িয়েছে, সেহেতু ধারণা করা যেতে পারে, নেহরুর তৃতীয় মেয়াদের মতো মোদির তৃতীয় মেয়াদে এই উত্তেজনা সীমান্ত সংঘাতে রূপ নিতে পারে। তবে ভারত মনে করে, ১৯৬২ সালের মতো অবস্থা এখন আর নেই; তারা এখন চীনের সমকক্ষ জবাব দিতে প্রস্তুত আছে।
ভূকৌশলগত কারণে এখন ভারতের প্রয়োজন কথিত চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডরের বিপরীতে আরও সুরক্ষিত বিকল্প সরবরাহ পথ তৈরি করা। এই কাজ তারা দ্রুত শুরু করতে চায়।
এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের সহযোগিতা আশা করে। সে ক্ষেত্রে পূর্ব সীমান্তে চীন-ভারত সম্ভাব্য সংঘাত বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা শুধু ভূকৌশলবিদদেরই নয়, ভূরাজনীতিবিদদেরও ভেবে দেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)