একাদশ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবী শ্যামল রায় (ছদ্মনাম)। মতিঝিল সরকারি কলোনিতে দুই কক্ষের একটি বাসায় থাকেন। ভাড়া বাবদ বেতনের ৪০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়। ছোট সংসারে স্বামী–স্ত্রী এবং আট বছরের একটা সন্তান। তিনি নিজে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী। ফলে নিয়মিত তাঁকে ওষুধের পেছনে ব্যয় করতে হয়। গত কয়েক মাসের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিতে (সরকারি হিসাবে কয়েক মাসের মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের একটু ওপরে। তবে কোনো কোনো গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের দাবি, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে) প্রতি মাসেই সাংসারিক খরচের একেকটা খাত কেটে ফেলতে হচ্ছে।
শ্যামল বলছিলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসেও বাসার সবার জন্য দিনে একটা করে ডিম বরাদ্দ ছিল। গত দুই মাসে শুধু বাচ্চাটাকে দিনে একটা করে ডিম খেতে দেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার মধ্যরাতে (৫ আগস্ট) হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম একলাফে বেড়ে যাওয়ার ধাক্কায় বাজারে সেই ডিমের দামও একলাফে বেড়ে গেছে। ছয় মাস আগেও যে ডিম ৯০ টাকা ডজন কিনতেন এখন সেটা ১৫০ টাকা। আবার চাল, ডাল, তেল, সাবান, শাকসবজি, মুরগি, মাছ, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম গত কয়েক মাসে বাড়তে বাড়তে এক জায়গায় এসে একটু কেবল যখন স্থির হয়েছিল, সে সময়ে জ্বালানি তেলের ধাক্কায় সব হিসাব–নিকাশ তছনছ হয়ে গেছে। আগে মতিঝিল কলোনি থেকে অফিসে যাতায়াত করতেন রিকশায়। গত কয়েক মাসে শুধু অফিস থেকে ফেরার সময় রিকশায় চড়েছিলেন। এবারের ধাক্কার পর এখন আসা–যাওয়া দুটোই চলছে হেঁটে। বলছিলেন, কেবল তো মাসের অর্ধেকটা দিন পেরুল। আরও কয়েক দিন গেলে সংসার খরচের টানাটানিটা হাড়ে হাড়ে টের পাব।
শাহরিয়ার আলম। একটি বেসরকারি সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা। গত কয়েক মাসের টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠান বছরের মাঝখানেই বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টের অর্ধেকটা দিয়ে দিয়েছে। আয়–ব্যয়ের মাঝে ভারসাম্য রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেও কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ফলে বছরের মাঝখানে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ইনক্রিমেন্ট একটু স্বস্তি এনে দিয়েছিল। সেই স্বস্তির রেশ এক সপ্তাহও পার না হতেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সুনামির মুখে পড়তে হলো। অকটেনের যে দাম বেড়েছে, তাতে ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনে যে খরচ বাড়বে, তা তাঁর বর্ধিত বেতনের চেয়েও বেশি। জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কোনো হিসাব–নিকাশেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের পাটিগণিত মিলছে না।
কোনো মাসে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি মানে কারও প্রকৃত বেতন থেকে ১০ টাকা নাই হয়ে যাওয়া। একলাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নতুন মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাদের মাঝে দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয় জেঁকে বসেছে। এ সময়ে বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে বাস করছে কি না, না খেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে কি না, কিংবা গায়ে জামাকাপড় থাকছে কি না—এ ধরনের যুক্তি দেওয়া শুধু কুযুক্তি নয়, নিষ্ঠুরতাও। মন্ত্রীরা কি বলতে পারবেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে বাড়তে আর প্রকৃত আয় কমতে কমতে স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়া নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নাগরিকেরা আর কতটা মানিয়ে জীবনযাপন করবে। জুতার মাপে পা কাটতে কাটতে পা টাই নাই হয়ে যাচ্ছে যে।
৪০ বছর বয়সী আবদুর রহমান ১৫ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরে। স্ত্রী, আট ও ছয় বছর বয়সী দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকে। তিনি ঢাকার রায়েরবাজারে একটি রিকশার গ্যারেজে আরও ১০ জন রিকশাচালকের সঙ্গে থাকেন। গত বছরের নভেম্বরে আগের দফায় জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ার আগপর্যন্ত ঢাকায় ১৫ দিন রিকশা চালিয়ে ১৫ দিন গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে গিয়ে কাটাতেন। এভাবেই চলে আসছিল তাঁর জীবন। নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ঢাকা–গাইবান্ধার বাসভাড়াসহ জীবনযাত্রার ব্যয় সব ক্ষেত্রেই বেড়ে যায়। ফলে ১৫ দিন ঢাকায় আর ১৫ দিন বাড়িতে থাকার সেই রুটিন ভেঙে ফেলতে বাধ্য হন। এক মাস পরপর বাড়ি গিয়ে সাত দিন থেকে আবার ঢাকায় ফিরতে হচ্ছিল তাঁকে। এবারের ধাক্কায় সেটা কত দিন পরপর হবে, তা তিনি বলতে পারছেন না। বলছিলেন, ‘রিকশা চালানো অনেক মেহনতের। একটানা চালাইলে শরীর ভাইঙ্গা যায়। কিন্তু কি করুম, উপায় তো নাই। যেমনে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সংসার চালামু কেমনে। প্যাসেঞ্জারের কাছে বাড়তি ভাড়া চাইলে খ্যাচখ্যাচ করে। তারাও দিবে কোত্থিকা। তাদের কি আয় বাড়ছে?’
বিশ্বজুড়ে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ মূল্যস্ফীতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির চেয়েও বড় এক নীরব ঘাতক এই মূল্যস্ফীতি। সাধারণ এবং নির্দিষ্ট আয় ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি রীতিমতো জীবন–জীবিকার সংকট। আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ, করোনা মহামারি, মহামারিপরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও জ্বালানিযুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে কয়েক শ কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি বিপুলসংখ্যক নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের জীবনে মূর্তিমান সংকট হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এক সুতোয় গাঁথা। তাই মূল্যস্ফীতি ঝড়ের বাইরে আমরা নই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মূল্যস্ফীতি কতটা বৈশ্বিক সংকটের কারণে আর কতটা নিজেদের ডেকে আনা, সে প্রশ্নটা তোলা জরুরি। অর্থপাচার ঠেকানোর ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভুল নীতির খেসারত কেন জনগণকে দিতে হবে? জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হবে, সেটা বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু একধাপে তেলের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কেন বিশাল অঙ্কের মূল্যস্ফীতিকে লালগালিচা করে ডেকে আনা হলো, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ভাষ্য নেই সরকারের। বরং নানা বৈপরীত্যময় বক্তব্যে জনমনে সংশয়, উৎকণ্ঠা, ভয়, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা জন্ম নিয়েছে। আর গত কয়েক দিনে মন্ত্রীদের অসংবেদনশীল বক্তব্য দুর্বিষহ সময়ের মধ্যে পড়া মানুষের কাটা ঘায়ে ঠিক নুনের ছিটে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
জ্বালানির দাম একধাপে বাড়ালে, জনজীবনে তার প্রভাব বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী। জ্বালানি–দারিদ্র্য বলে নতুন একটা বিষয় এখন আলোচিত হচ্ছে। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সম্প্রতি গার্ডিয়ানে লেখা একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন, একলাফে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাজ্যে কীভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ গরিব হয়ে গেছেন। জ্বালানি–দারিদ্র্য কীভাবে হীনম্মন্যতায় ভোগা একটা প্রজন্ম তৈরি করছে। অনেক শিশুর মা–বাবা সন্তানদের টাকার অভাবে স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে সংকোচ বোধ করছে। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসের শিশুদের মতো একটা গ্লানিকর শৈশব ব্রিটেনের শিশুদের শুরু হয়েছে। গত এপ্রিলে একধাপে জ্বালানির দাম ৫৪ শতাংশ বাড়ার কারণে ব্রিটেনের ১ কোটি পরিবারের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে জ্বালানি-দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়তে হয়েছে। অক্টোবর মাসে সেখানে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধির কথা চলছে। এর ফলে, সেখানকার ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যে পড়বে। গর্ডন ব্রাউন মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারা রাজনীতিকদের সমালোচনা করে বলছেন, ‘ক্ষমতার কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, মানুষের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠুরতা শুধু অযোগ্যতা ও অসংবেদনশীলতা নয়, সেটা অনৈতিকও।’
আমাদের দেশে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক ধাক্কায় কত কোটি মানুষ গরিব হয়ে গেল, এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কি পাওয়া যাবে? কিন্তু চারপাশে আত্মীয়–স্বজন–বন্ধু–প্রতিবেশী কিংবা নিজের ঘরে পরিস্থিতি যা, তাতে সবাই এখন মূল্যস্ফীতির বড় শিকার। কম খেয়ে, চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে, সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কিংবা প্রয়োজনীয় চাহিদা কাটছাঁট করে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন সবাই। করোনা মহামারির সময়েও মানুষ সেভাবেই নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিলেন। দেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আরও চার কোটি মানুষ একেবারে দারিদ্র্যের সীমান্তরেখায় বাস করনে। মূল্যস্ফীতি মানে, প্রকৃত আয় কমে যাওয়া।
কোনো মাসে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি মানে কারও প্রকৃত বেতন থেকে ১০ টাকা নাই হয়ে যাওয়া। একলাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নতুন মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাদের মাঝে দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয় জেঁকে বসেছে। এ সময়ে বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে বাস করছে কি না, না খেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে কি না, কিংবা গায়ে জামাকাপড় থাকছে কি না—এ ধরনের যুক্তি দেওয়া শুধু কুযুক্তি নয়, নিষ্ঠুরতাও। মন্ত্রীরা কি বলতে পারবেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে বাড়তে আর প্রকৃত আয় কমতে কমতে স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়া নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নাগরিকেরা আর কতটা মানিয়ে জীবনযাপন করবে। জুতার মাপে পা কাটতে কাটতে পা টাই নাই হয়ে যাচ্ছে যে।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক