সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সদ্য সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান কতটা ক্ষমতাবান ছিলেন, তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের লেখায়। মতিউরের বদলির জন্য একজন সাবেক সেনা প্রধানসহ কয়েকজন জেনারেল পর্যন্ত তদ্বির করেছিলেন।
সেই তদ্বিবের কথা বলার আগে মতিউরের বর্তমান অবস্থানটা একটু দেখে নিই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান কোথায় আছেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বলছে, তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তিনি যেই বিভাগে কাজ করেন, সেই বিভাগের কর্মকর্তারাও কিছু জানেন না।
ছেলে ইফাতের ছাগল-কাণ্ডের পরও মতিউর একটি টেলিভিশন চ্যানেলে নিজের আর্থিক সততা সম্পর্কে সাফাই গেয়েছেন। আর সেই সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি নিজের ছেলেকেও অস্বীকার করেন।
এনবিআরের একদা প্রতাপশালী সদস্য মতিউর রহমানকে নিয়ে ২৫ জুন প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘দেশে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, বিদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা’।
সোমবার সারা দেশে চাউর হয়ে যায়, মতিউর প্রথম স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে চলে গেছেন। এ নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও বের হয়েছে। এর আগে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তাঁর ছেলে ইফাত মালয়েশিয়া পালিয়ে যান।
সোমবার দুপুরে প্রথম আলোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি শাহাদত হোসেনের সঙ্গে কথা বলি। মতিউর রহমান নামের কেউ আখাউড়া বন্দর দিয়ে রোববার দেশ ত্যাগ করেছেন কি না। তিনি আখাউড়া বন্দরে খোঁজখবর নিয়ে জানালেন, এই নামে কেউ দেশ ত্যাগ করেননি। তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? তাঁর দেশত্যাগের খবর কি তা হলে সঠিক নয়? নাকি ভিন্ন নামে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশে ক্ষমতাধরদের ভিন্ন নামে এনআইডি ভিসা করা অবশ্য কোনো ঘটনা নয়।
ছাগল-কাণ্ডের সূত্রে মতিউরের বিশাল সম্পদের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রথম আসে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম পরে বিষয়টি তুলে ধরতে শুরু করে।
কিছুদিন আগেও যেই ব্যক্তি প্রচণ্ড দাপট দেখাতেন, তিনি দেশ থেকেও হাওয়া হয়ে গেলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান। তিনিও পুত্রের ছাগল-কাণ্ডের পর অফিসে যাননি।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, মতিউরের দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রীরই সম্পদ বেশি। বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই দম্পতি।
কিছুদিন আগেও মতিউর ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি কী করে ‘হাওয়া’ হয়ে গেলেন? কেউ বলছেন দেশেই আছেন। দেশে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত তাঁকে খুঁজে বের করা। তাঁর দেশ ত্যাগের জল্পনা ছড়িয়ে পড়ার কারণ সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের সপরিবার দেশত্যাগের ঘটনা।
দুদক যখন তাঁর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে, তার সম্পদ জব্দ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাঁকে সশরীর কার্যালয়ে হাজির হতে বলে, এর আগেই তিনি সিঙ্গাপুর চলে যান। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে সাক্ষাতের সময়ও একবার বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো খবর নেই।
বদিউর রহমান তাঁর বইয়ে এনবিআরের চার সদস্যের বরাত দিয়ে লিখেছেন, তিনি (মতিউর) অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের বেড রুম পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। সাইফুর রহমানের বেড রুমেও যেতে পারতেন। তাঁর স্ত্রী বিয়োগের পর কবরস্থানে গিয়ে কান্নাকাটি করেছেন। এনবিআর থেকে বদিউর রহমানকে বদলি করার পর এই কর্মকর্তা ঠিকই রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের অবস্থান এখন কোথায়, সে বিষয়ে তাঁর স্বজন ও সহকর্মীরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছেও তাঁর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে দুদক জানতে পেরেছে, মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউরের দেশত্যাগে সোমবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের দেওয়া এই নিষেধাজ্ঞার আওতার মধ্যে আরও রয়েছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাঁদের ছেলে আহাম্মেদ তৌফিকুর রহমান (অর্ণব)।
এনবিআরের আলোচিত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তাঁর স্বজনদের নামে এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২৫ দশমিক ৭০ বিঘা) জমি রয়েছে। ঢাকাতেই তাঁর নামে ফ্ল্যাট রয়েছে অন্তত চারটি। ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে লায়লা কানিজ তাঁর মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
শেয়ারবাজারে মো. মতিউর পরিচিত ছিলেন বাজে কোম্পানির ‘প্লেসমেন্ট-শিকারি’ হিসেবে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ নিজের নামে খোলা পাঁচটি বিও হিসাব থেকে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছেন তিনি।
এই করিতকর্মা এনবিআর কর্মকর্তা সম্পর্কে তাঁর এককালীন বস ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের লিখিত পর্যবেক্ষণ আমাদের হাতে এসেছে। বদিউর রহমান তাঁর সরকারি চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন। এর একটি বইয়ের নাম কোদালকে কোদাল বলি।
এই বইয়ের একটি লেখার উপশিরোনাম হলো: ‘মতিউরের বদলি বাতিলের তদবির কেন এবং কীভাবে ঠেকালাম’।
এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে তিনি রুটিনমাফিক কর্মকর্তাদের বদলির সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় মতিউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে যুগ্ম কমিশনার। তাঁকে যেদিন রাজশাহীতে বদলির সিদ্ধান্ত হয়,সেদিনই বোর্ডের চারজন সদস্য দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘আপনি মতিউরকে বদলি করলেও রাখতে পারবেন না।’ কিন্তু বদিউর রহমান তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
কিন্তু এরপর সামরিক ও বেসামরিক মহল থেকে তাঁর জন্য তদবির আসতে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লিখিত চিঠিতে জানায়, তাদের ছাড়পত্র ছাড়া মতিউর রহমানকে বদলি করা যাবে না। বদিউর রহমান তাদের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করেন। এরপর চট্টগ্রামে কর্মরত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির বদলির আদেশ বাতিলের অনুরোধ করেন। তৎকালীন সিজিএস মেজর জেনারেল সিনাহ ইবনে জামালীও তাঁর পক্ষে ওকালতি করেন।
এমনকি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমদ এনবিআর চেয়ারম্যানকে টেলিফোন করে মতিউরের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি বলেন, আমাকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের পদ থেকেই সরিয়েই সেটি সম্ভব। সে সময়ে মতিউর নিজে এনবিআর চেয়ারম্যানের বাড়ি ও অফিসে ধরনা দিয়েও দেখা করতে পারেননি। বদিউর রহমান যত দিন চেয়ারম্যান ছিলেন, মতিউরকে রাজশাহীতেই থাকতে হয়।
বদিউর রহমান তাঁর বইয়ে এনবিআরের চার সদস্যের বরাত দিয়ে লিখেছেন, তিনি (মতিউর) অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের বেড রুম পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। সাইফুর রহমানের বেড রুমেও যেতে পারতেন। তাঁর স্ত্রী বিয়োগের পর কবরস্থানে গিয়ে কান্নাকাটি করেছেন। এনবিআর থেকে বদিউর রহমানকে বদলি করার পর এই কর্মকর্তা ঠিকই রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও যে মতিউর রহমানের সমস্যা হয়নি, সেটা একই সঙ্গে এনবিআরের সদস্য, আপিল বোর্ডের প্রধান ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকাই প্রমাণ করে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি