পাটিগণিতের ‘ধরি’ কায়দায় আসুন ধরি;—বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে আপনি চেপে বসেছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জোড়া ইঞ্জিনের এই উড়োজাহাজ যে সে জিনিস না।
উইকিপিডিয়া বলছে, এই বিমান প্রকারভেদে তিন থেকে চার শ যাত্রী নিয়ে ৫ হাজার ২৩৫ থেকে ৯ হাজার ৩৮০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে।
ধরি, উড়োজাহাজটা মাঝ আকাশে তুলার মতো মেঘ ভেদ করে ছুটে চলেছে। আপনি জানালায় চোখ রেখে সেই দৃশ্য দেখছেন। নয়নাভিরাম দৃশ্যের আরামে আপনার নয়ন বুজে আসছে। আপনার মনে হচ্ছে ‘আকাশে শান্তির নীড়’।
ঠিক এমন সময় আপনি দেখলেন, আপনার পাশের যাত্রীটি বিড়বিড় করে দোয়া–দরুদ পড়ছেন। আপনি তাঁকে বললেন, ‘কী হয়েছে? আপনি কাঁপছেন কেন? ঘামছেন কেন?’
সহযাত্রীটি ফিসফিস করে বললেন, ‘ভাই সাহেব, প্লেনে ওঠার সময় এক ভদ্রলোকের কাছে শুনলাম, যে পাইলট এই প্লেন চালাচ্ছে, সে নাকি আদতে পাইলট না। সে নাকি আগে নীলক্ষেত টু খিলক্ষেত মুড়ির টিন চালাত। কী জানি কী কায়দা করে সে-ই পাইলট হয়েছে। সে এখন এই প্লেন চালাচ্ছে। তার সঙ্গে ককপিটে যে কো-পাইলট আছে, সে নাকি নছিমনের হেলপার ছিল। এই বিষয় নিয়ে সামান্য পেরেশানিতে আছি।’ এই বলে ভদ্রলোক আগের চেয়ে বেশি কাঁপতে লাগলেন।
ধরি, সেই ভদ্রলোকের কথা শুনে আপনার মেজাজ খারাপ হলো। ফালতু কথা বলা বেকুব কিসিমের এই মানুষটাকে এড়ানোর জন্য হাতের মোবাইল ফোন নিয়ে আপনি ফেসবুকে মন দিলেন। আচমকা একটা নিউজ লিংকে আপনার চোখ আটকে গেল। আপনি দেখলেন, সেই খবরে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বিমান বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ চালানোর জন্য নতুন ১৪ জন বিমান চালক নিয়োগ দিয়েছে।
এর মধ্যে ৮ জন ক্যাপ্টেন (পাইলট) আর ৬ জন ফার্স্ট অফিসার (এফও) বা কো-পাইলট। কেউ এই উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন অথবা এফও হতে চাইলে যে জিনিস লাগবেই, তা হলো তাঁর কমপক্ষে তিন শ ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সে কথা উল্লেখও ছিল। কিন্তু বিমান যে আটজন ক্যাপ্টেনকে নিয়োগ দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র দুজনের এই অভিজ্ঞতা আছে। বাকি ছয়জনের তা নেই। এই ক্যাপ্টেনদের মধ্যে একজন আবার গত পাঁচ বছর কোনো উড়োজাহাজ চালানইনি।
ধরি, আপনি ভাবতে লাগলেন, যে লোক একসময় বাইসাইকেল চালাতেন, পাঁচ বছর যদি তিনি তা না চালান, আচমকা তাঁকে ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালাতে বললে তিনি কী করবেন? ওই ক্যাপ্টেনের দশা তো সেই বাইসাইকেলওয়ালার মতোই হওয়ার কথা।
ধরি, আপনি খবরে আরও দেখলেন, নিয়োগ পাওয়া ক্যাপ্টেনদের একজন একসময় চালাতেন এয়ারবাস। কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ওই খবরেই বলা আছে, এয়ারবাস চালানো পাইলট লম্বা প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ চালাতে পারেন না। তার মানে তাঁকে দিয়ে এই উড়োজাহাজে পাইলটগিরি করাতে গেলে সরকারি খরচে আবার তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
আপনি পড়ে দেখলেন, ক্যাপ্টেনদের মধ্যে তবু দুজনের উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু যে ছয়জন এফও বা কো-পাইলটকে নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের একজনেরও তা নেই। আপনি দেখলেন, নিয়োগ পাওয়া কো-পাইলটদের একজন এয়ারক্রাফট ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স পরীক্ষায় দুটি বিষয়ে ডাহা ফেল করেছেন।
ধরি, এই নিউজ পড়তে পড়তে আপনার নিশ্বাস ঘন হওয়া শুরু করল। আপনার সামান্য কাঁপুনি শুরু হলো। আপনি দেখলেন, নিয়োগ পাওয়া ছয়জন এফওর মধ্যে একজনকে ইতিপূর্বে দুটি বেসরকারি এয়ারলাইনস থেকে ‘ইন এফিশিয়েন্সি’ এবং ‘স্কিলের অভাব’-এর কারণে, সোজা বাংলায় অদক্ষতার কারণে বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তির কো-পাইলটের চাকরিটা পেতে বেগ পেতে হয়নি। কারণ, যে কমিটি তাঁদের নিয়োগ করেছে, সেই রিক্রুটমেন্ট কমিটির সদস্য ছিলেন তাঁর স্বামী।
ধরি, খবরের এই পর্যন্ত পড়ে আপনার দাঁতে বাড়ি খাওয়া শুরু হলো। কারণ, আপনি যখন খবরটি পড়ছেন, সে মুহূর্তে আপনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে। আপনার পিলে চমকাচ্ছে। কারণ, ততক্ষণে এই উড়োজাহাজটি আসলেই খিলক্ষেত টু নীলক্ষেতের মুড়ির টিনের কোনো ড্রাইভার চালাচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে আপনার মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে।
এবার ধরাধরি বাদ। এবার সত্যি সত্যি ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর ‘অ্যানোম্যালিস ইন হায়ারিং: রিজেন্টমেন্ট রানস রাইফ অ্যামাং বিমান পাইলটস’ (‘নিয়োগে অসংগতি: বিমানের পাইলটদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে’) শিরোনামের খবরটি পড়ুন। পুরো খবর পড়ার পর বিমানের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে না উঠেও আপনার দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়ার চান্স আছে। কারণ, আপনাকে ‘ধরি’, বলে যে খবরের তথ্য কল্পনা করতে বলেছিলাম, সেটি আসলে মোটেও ‘ধরার’ বিষয় ছিল না। সেটি আসলেই বাস্তব ঘটনা। সেই ‘ধরি’ পর্যায়ের সব তথ্যই সত্য।
ডেইলি স্টার পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগ পাওয়া ওই ১৪ জনের সবার সঙ্গে ৫ বছরের চুক্তি করা হয়েছে। অথচ বিমান বাংলাদেশ-এর নিয়ম অনুযায়ী এক বছরের বেশি মেয়াদে প্রাথমিক চুক্তি করা যায় না। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) গত ২৮ আগস্ট বিমানের এমডি এবং সিইওকে লেখা একটি চিঠিতে বলেছে, বিমান বাংলাদেশ-এর ভেতরেই ৩০ জন পাইলট আছেন, যাঁরা পদোন্নতি পেয়ে এই পদে আসতে পারেন। কিন্তু শুধু এই নতুন ১৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাঁদের পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য লেখাপড়া জানার দরকার নাই। গরু–ছাগল চিনতে পারলেই গাড়ি চালানো যায়’। ধরি, বিমানের কেউ বলে বসবেন, ‘আকাশে শান্তির নীড়, সেখানে গরু–ছাগলও নাই, সেখানে মুড়ির টিনের ড্রাইভারও প্লেন চালাতে পারে।’
নাম মনে করতে পারছি না, বিখ্যাত এমন কেউ একজন বলেছিলেন, ‘ইউ আর দ্য ফাস্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার, আই অ্যাম দ্য থার্ড; বাট রিমেমবার, দ্য প্লেন ইজ ক্র্যাশিং’। মাননীয় বাংলাদেশ বিমান, এই কথাটা প্লিজ একটু ‘ধরুন’, নইলে ফার্স্ট ক্লাস থেকে থার্ড ক্লাস—সব যাত্রী মারা পড়বে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক