মানুষকে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় আটকে রাখতে সব জায়গায় নানান ‘উপাদান’ লাগে। সেই তালিকায় যে গামছাও যুক্ত হতে পারে—এটা অবশ্য আসামের দিকে তাকিয়েই কেবল জানা গেল। রাজ্যটিতে অসমিয়াদের সঙ্গে বাঙালিদের পুরোনো মানসিক দূরত্ব আরও এক ধাপ বাড়াল সম্প্রতি গামছা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক কাজিয়া।
সাংস্কৃতিক বিবাদে রসদ জোগাল গামছা
বাঙালি সমাজ সচরাচর যে গামছা ব্যবহার করে অসমিয়া সমাজে সেটাই ‘গামোসা’ নামে পরিচিত। তবে গামোসার বুনন ও নকশায় সামান্য কিছু ফারাক আছে। দুটির ব্যবহার ও আকার কাছাকাছি—তবে দেখতে কিছুটা আলাদা। গামোসার দুই দিকে নকশাদার লাল বর্ডার থাকে।
আসামের ‘বাংলা সাহিত্য সভা’ গামছা ও গামোসা কেটে অর্ধেক অর্ধেক জোড়া লাগিয়ে তাদের এক অনুষ্ঠানে উপহার দিয়েছিল অতিথিদের। তারা এটার ভেতর দিয়ে বাঙালি সমাজের সঙ্গে অসমিয়া সমাজের মেলবন্ধন বাড়াতে বা বোঝাতে গিয়েছিল। ফল হয়েছে উল্টো। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো আসামজুড়ে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তাদের অভিযোগ এ রকম কাটাকাটি আর জোড়াতালিতে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন নয়—গামোসার অপমান হলো। ঘটনা এখানেই থেমে থাকল না। পুলিশের কাছেও নালিশ হলো এটা নিয়ে। এবং অবধারিতভাবে আসামজুড়ে নতুন করে বাঙালি-অসমিয়া সাংস্কৃতিক দূরত্ব বেড়ে গেল।
অসমিয়াদের এখনকার জনপ্রিয় নেতা অখিল গগৈ ‘সাহিত্যসভার সর্বশেষে উদ্যোগকে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের নামে ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিদের অসমিয়া সমাজে গ্রহণ করানোর সাংস্কৃতিক চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, এটা বিজেপির রাজনীতি এবং এর মাধ্যমে তারা অবৈধ হিন্দু বাঙালিদের এখানে নতুন করে নাগরিকত্ব দিতে চায়। গগৈর এ রকম উত্তেজক মন্তব্য গামছা ও গামোসার বিতর্ককে জড়িয়ে ফেলছে আসামের রক্তাক্ত অতীতের সঙ্গে—যেখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাজির ছিল বাংলাদেশ।
বিজেপি নেতা, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এ ঘটনার সুযোগ নিতে একটুও দেরি করেননি। তিনি হঠাৎই গামোসা বুননঘর ঘুরতে বের হলেন। এটাও ঘোষণা দিলেন এবারের ‘বিহু’তে সবাইকে গামোসা কিনতে হবে। এতে গামছার বাজারে কী ঘটবে, সেটা সহজেই বোধগম্য। বিহু হলো কৃষিভিত্তিক আসামের জাতীয় উৎসব। বিশ্ব শর্মা সে সময় রীতিমতো ৬০ লাখ গামোসা বিক্রির একটা আওয়াজও দিয়েছেন (সাময়িক প্রসঙ্গ, ১ এপ্রিল)। স্বভাবত আসামজুড়ে গামোসা তৈরি করা সমাজ একটা বাড়তি উদ্দীপনা চলছে এখন। এই উদ্দীপনায় জ্বালানি জোগাতে ‘মেখেলা’ নামে পরিচিত মেশিনে তৈরি আরেক ধরনের গামোসাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন হাতে বোনা গামোসার প্রসার।
জিআই সনদ যখন জাতীয়তাবাদী গর্ব জোগায়
আসামজুড়ে বাংলাভাষীদের অনেক পুরোনো সাহিত্য সংগঠন আছে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সংগঠন হলো ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন’। এর বাইরে আছে মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি, নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র ইত্যাদি। এসবের তুলনায় ‘বাংলা সাহিত্য সভা’ বেশ নবীন। এটা বিজেপির আনুকূল্যে গড়ে ওঠা বলে অনেকের মত। ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে তারা গামছা ও গামোসাকে কেটে জোড়া লাগানোর আগে এর জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া আমলে নেয়নি বলেই মনে হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে আসাম গামোসার জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস অব গুডস) নথিভুক্ত করতে সমর্থ হয়। তখন থেকে বিষয়টি অসমিয়া সুশীল সমাজ বেশ গর্বের সঙ্গে জনসমাজে তথ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। জিআই রেজিস্ট্রি জার্নাল তখন বলেছিল ‘গামোসা আসামের সনাতনি পোশাক।’ এ রকম সনদের পর সমাজে মানসম্মানে গামোসার পেছনে পড়ে যায় গামছা। কিন্তু আসামের সমাজের কেউ তখন প্রশ্ন করেনি গামছা কেন সনাতনি পোশাক নয়? জিআই কেবল গামোসার হবে কেন?
অসমিয়ারা গামোসার ‘অপমানে’ ক্ষুব্ধ!
আসামে বরাবরই জাতীয়তাবাদী আবেগ ও আন্দোলনে ছাত্ররা সামনে থাকে। বিশেষ করে অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গামছা ও গামোসার সেতুবন্ধনের বিরুদ্ধে সবার আগে রাজপথে তারা ক্রোধ দেখায়। টিভিগুলোতে উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়। বিষয়টা থানা পর্যন্ত গড়ানোমাত্র সাহিত্যসভা দ্রুত ক্ষমা চায়।
অসমিয়াদের যুক্তি হলো গামোসা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। গামছার সঙ্গে গামোসার সংযোগে সেই পরিচয় কীভাবে আহত হয়, সে বিষয়ে তাঁরা ব্যাখ্যা দিতেও প্রস্তুত নন। বোঝা যাচ্ছে, মূল বিষয়—বাঙালি সমাজকে তারা অসমিয়া সংস্কৃতির সঙ্গে মেলামেশা করতে দিতে আগ্রহী নন। বাঙালি সংস্কৃতিও যে আসামের শত শত বছরের সাংস্কৃতিক অংশীদার সেটা যেন তাঁরা মানতে অনিচ্ছুক।
তবে অসমিয়াদের এই বক্তব্য খুবই সত্য, গামোসা এখানকার আদি সংস্কৃতির অংশ। কেবল গলা ও ঘাড়ের দুদিকে ঝুলিয়ে রাখা নয়—অনেক সময় পবিত্র কিছু ঢেকে রাখতেও গামোসা কাজে লাগে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামেও দেখা গেছে গামোসার ওপর স্লোগান লিখে তুলে ধরা হয় বক্তব্যের গুরুত্ব বোঝাতে। সেই তুলনায় গামছা বাঙালি সমাজের নিত্যব্যবহারের এক সামগ্রী। কিন্তু তাতে গামছার সাংস্কৃতিক মূল্য কেন কমতে পারে—সেটা বোঝা মুশকিল! অসমিয়া একাংশের এবারের আচরণে মনে হলো গামোসার তুলনায় গামছা যেন খানিক কম পবিত্র!
এই মনোভাব একধরনের সাংস্কৃতিক বর্ণবাদের স্মারক কি না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। যদিও বাঙালি তরফ থেকে তেমন প্রশ্ন প্রকাশ্যে তোলা আসামে বেশ দুরূহ। গত অক্টোবরে আসামের গোয়ালপাড়ায় কৃষিজীবী বাঙালি মুসলমানরা (‘মিঞা’ নামে পরিচিত) ছোট একটা সাংস্কৃতিক জাদুঘর খুলতে গেলে গ্রেপ্তার হয়েছিল রীতিমতো সন্ত্রাস আইনে। এই মিঞা মুসলমানদের লুঙ্গিও আসামে অনেক আলাপের বিষয় হয়ে আছে। একজন বাঙালি এমপি লুঙ্গিকে বাঙালিদের পোশাকের হিসেবে জাদুঘরে প্রদর্শনের প্রস্তাব দেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়েছিল ২০২০-এর নভেম্বরে।
‘বাংলা সাহিত্য সভা’র উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস-বিতর্ক
অসমিয়াদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার বাইরে বাঙালিদের অনেকেও সাহিত্যসভার গামছা ও গামোসাকেন্দ্রিক উদ্যোগের পেছনে সাংস্কৃতিক রাজনীতি আছে বলে দাবি করছে। আসামে বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় আছে। বিজেপি আগ্রহী মূলত একাংশ নিয়ে। তারা হিন্দু বাঙালিদের অসমিয়া হিন্দুদের কাছাকাছি আনতে চাইছে। তাদের প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে নাগরিকত্বহীন হিন্দু বাঙালিরা নাগরিকত্ব পাবে বলে প্রত্যাশা তৈরি করা হয়েছিল। ‘বাংলা সাহিত্য সভা’ বিজেপির ওই রাজনীতির সাংস্কৃতিক লাইন অনুসরণ করছে। বিশেষ করে সব উপায়ে অসমিয়া হিন্দুদের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুদের এককাতারে আনার লক্ষ্যে সাহিত্য অঙ্গনে সচেষ্ট তারা।
গুয়াহাটিতে এবারই তাদের প্রথম সম্মেলন হলো। সেখানে রাজ্য সরকার ও বিজেপির অনেক সম্মানীজন ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী রঞ্জন পেগু ছিলেন অতিথি। ছিলেন শিলাদিত্য দেব, যিনি বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ এক সংগঠক। এ দুজনের মাঝে শিলাদিত্য বাংলাদেশ প্রশ্নে বরাবর খুব আক্রমণাত্মক। ২০১৮ সালে তিনি এও বলে ফেলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি একটা বড় ভুল হয়ে গেছে’ (২০ মার্চ, টাইমস অব ইন্ডিয়া)। এ রকম সংগঠকেরা যখন গামছা ও গামোসা জোড়া লাগিয়ে নামলেন তখন স্বভাবত অনেকে বিষয়টা সন্দেহের চোখে দেখছিল। তাদের মতে, বাংলা সাহিত্য সভার উদ্যোগ সাংস্কৃতিক দিক থেকে যতটা আন্তরিক—এর পেছনকার মানুষেরা ধর্মীয় বিবেচনায় আবার সূক্ষ্মভাবে ততটাই বিভেদবাদী। এ রকম অভিযোগ স্থানীয় মুসলমান সাহিত্যকর্মীদের তরফ থেকেও—বাংলা সাহিত্য সভার নেতৃত্ব পর্যায়ে যাদের বিশেষ ঠাঁই হয়নি।
অন্যদিকে সাহিত্য সভার উদ্যোগের প্রতি অসমিয়াদের প্রতিক্রিয়া দেখে আবারও স্পষ্ট হলো—তারা হিন্দুত্বে আগ্রহী হলেও বাঙালিত্বকে ‘অপর’ হিসেবে দেখতে ও রাখতে চায়। অসমিয়াদের এখনকার জনপ্রিয় নেতা অখিল গগৈ ‘সাহিত্যসভার সর্বশেষে উদ্যোগকে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের নামে ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিদের অসমিয়া সমাজে গ্রহণ করানোর সাংস্কৃতিক চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, এটা বিজেপির রাজনীতি এবং এর মাধ্যমে তারা অবৈধ হিন্দু বাঙালিদের এখানে নতুন করে নাগরিকত্ব দিতে চায়। গগৈর এ রকম উত্তেজক মন্তব্য গামছা ও গামোসার বিতর্ককে জড়িয়ে ফেলছে আসামের রক্তাক্ত অতীতের সঙ্গে—যেখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাজির ছিল বাংলাদেশ।
অসমিয়া সমাজে বাংলা ও বাঙালি নিয়ে অস্বস্তি ও বিরাগ যে কত গভীর, সেটাই আবার প্রকাশ হয়ে পড়ল গামছা বনাম গামোসা বিবাদে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক