২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ভূরাজনৈতিক সংঘাতে বিশ্ববাণিজ্য কোন দিকে যাচ্ছে?

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা বিশ্ববাণিজ্যকে সংকটে ফেলেছেছবি : রয়টার্স

বিশ্ববাণিজ্যের জন্য গত বছরটা যে ভালো যায়নি, তা স্পষ্ট। চলতি বছরও যদি একই প্রবণতা বজায় থাকে, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য তা সুখকর হবে না। তাই এ বছর বিশ্ববাণিজ্য যেন জোরালোভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, এ রকম একটা তাগিদ আন্তর্জাতিকভাবে জোরেশোরেই অনুভূত হচ্ছে।

কিন্তু বাণিজ্য তো আর জোর করে চাঙা করা যায় না। এটা হয় বৈশ্বিক অনুকূল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা অবশ্য বছরের প্রথম প্রান্তিকের বাণিজ্যপ্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে করে বলা যায়, বিশ্ববাণিজ্য এ বছর তেজি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।

এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) যে পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, গত বছর, মানে ২০২৩ সালে বিশ্ববাণিজ্য পরিমাণগত ১ দশমিক ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার পর চলতি বছর বা ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৬০ শতাংশ হারে বাড়তে পারে। আর আগামী বছর এই হার হতে পারে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ডব্লিউটিওর হালনাগাদকৃত প্রতিবেদনে অবশ্য একই সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্য ঘুরে দাঁড়ানোর বাধা হিসেবে তিনটি ঝুঁকিকে উল্লেখ করা হয়েছে।

এগুলো হলো—আঞ্চলিক সংঘাত, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক নীতিবিষয়ক অনিশ্চয়তা।

অর্থমূল্যের দিক দিয়ে গত বছর বৈশ্বিক পণ্য–বাণিজ্য তার আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কমে গিয়ে হয়েছিল ২৪ লাখ কোটি (বা ২৪ ট্রিলিয়ন) ডলার। তবে সেবা খাতের বাণিজ্য প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে ৭ লাখ কোটি (সাড়ে ৭ ট্রিলিয়ন) ডলারে।

এই সময়ে আমদানিও বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রে প্রথম প্রায় চার মাসে (২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) আমদানি ব্যয় ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়ার তথ্য পাওয়া যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দেশে শিল্প খাতে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, যা বিনিয়োগ বাড়ার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হওয়ার লক্ষণ।

আবার এর আগের মার্চ মাসের প্রথম দিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখানো হয়, সার্বিকভাবে বিশ্ববাণিজ্য ২০২২ সালের তুলনায় ৩ শতাংশ বা প্রায় ১ লাখ কোটি ডলার কমে ২০২৩ সালে প্রায় ৩২ লাখ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

এ সময় পণ্য–বাণিজ্য প্রায় সোয়া লাখ কোটি ডলার কমে গেলেও সেবা খাতের বাণিজ্য ৫০ হাজার কোটি ডলার বা ৮ শতাংশ বাড়ে।

দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনেই দেখানো হয়েছে, পণ্য–বাণিজ্য কমে গিয়েই ২০২৩ সালে সার্বিক বিশ্ববাণিজ্য কমেছিল; যদিও এ সময় বেড়েছিল সেবা খাতের বাণিজ্য। আর তাই পণ্য–বাণিজ্য চাঙা হওয়ার দিকেই এখন মনোযোগটা বেশি।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে কিছুটা আশাবাদী পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছরও ৩ শতাংশ হারে বাড়তে পারে, আর তা সম্ভব হবে বাণিজ্য তেজি হওয়ার মধ্য দিয়ে।

পরিবেশবান্ধব পণ্যগুলো, বিশেষত ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা বেশ জোরাল হয়ে উঠছে, যা মোট পণ্য–বাণিজ্যকে তেজি করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জাতিসংঘের সংস্থাটি মনে করে।

পাশাপাশি সংস্থাটি এটা বলেও সতর্কতা উচ্চারণ করেছে, লোহিত সাগর, কৃষ্ণসাগর ও পানামা খাল দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হলে একদিক যেমন খরচ বাড়বে, অন্যদিকে তেমনি সরবরাহপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। আবার চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও আঞ্চলিক সংঘাতগুলো জ্বালানি ও কৃষিপণ্যের বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে। এ সবকিছুর সমষ্টিগত ফল হবে বাণিজ্যের গতি ধীর হয়ে পড়া।

আঙ্কটাড ও ডব্লিউটিও অবশ্য তাদের প্রতিবেদন ও পূর্বাভাসে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে বিবেচনায় নেয়নি বা নিতে পারেনি।

কেননা তার আগেই এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে আঞ্চলিক সংঘাত ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা—দুটি ক্ষেত্রেই ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বাড়তি ঝুঁকি যোগ করেছে। যদিও দুই দেশ পাল্টাপাল্টি খুব সীমিত আকারে পরস্পরের প্রতি মিসাইল ছুড়ে থেমে গেছে, তবু মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি উত্তেজনাকরই রয়ে গেছে।

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে হামলা ও গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই উত্তেজনা কমবে না। ওদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো কোনো পরিণতির দিকে যেতে পারেনি। ফলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাও কমছে না শিগগিরই।

এমতাবস্থায় বাণিজ্য কমে যাওয়ার মানেই হলো বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া বা শ্লথ হওয়া। প্রায় প্রতিটি দেশই এখন একে ওপরের ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল—খাদ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি থেকে তৈরি পোশাক ও যন্ত্রপাতি রপ্তানির জন্য।

সুতরাং বাণিজ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে আমদানি ও রপ্তানি দুই–ই ব্যয়বহুল হবে, যা জাতীয় আয় ও ভোগব্যয় কমিয়ে দেবে। ফলে সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। এটা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।

উল্লেখ্য, গত বছর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) পণ্য রপ্তানি ২০২২ সালের ২৬ হাজার ৯০০ কোটি (বা ২৬৯ বিলিয়ন) ডলার থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ কমে হয়েছে ২৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এতে করে বৈশ্বিক পণ্য রপ্তানিতে এলডিসির হিস্যা ১ দশমিক ১০ শতাংশেই অপরিবর্তিত রয়েছে।

আবার এলডিসিগুলোর পণ্য আমদানি ২০২২ সালের ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার থেকে কমে গত বছর ৩১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার হয়েছে। মানে আমদানি কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। তাতে করে বৈশ্বিক পণ্য আমদানিতে এলডিসির হিস্যা আগের বছরের প্রায় দেড় শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে হয়েছে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ।

ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, এলডিসির বাণিজ্য কমে যাওয়াকে একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবিলায় এসব দেশের সম্পদ সীমিত।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের তালিকা অনুসারে, বর্তমানে ৪৫টি দেশ এলডিসির কাতারে রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি দেশ এই তালিকা থেকে বের হয়ে আসার বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। আর এটা প্রায় নিশ্চিত যে ২০২৬ সালের শেষভাগে বাংলাদেশ, নেপাল ও কম্বোডিয়া এলডিসির শ্রেণি থেকে বেরিয়ে আসবে।

বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশের পণ্য–বাণিজ্যও ২০২৩ সালে নিম্নমুখী হয়েছে। যদিও পণ্য রপ্তানি আগের ২০২২ সালের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেড়ে ৫ হাজার ৫৮০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছিল, পণ্য আমদানি প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গিয়ে ঠেকে ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে। এর ফলে মোট পণ্য–বাণিজ্য ১৪ শতাংশ কমে হয় ১২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।

পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত এক দশকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পণ্য–বাণিজ্যে এটা তৃতীয়বারের মতো ধস এবং সবচেয়ে বড় ধস। এর আগে করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির নেতিবাচক প্রভাবে মোট পণ্য–বাণিজ্য ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

তখন অবশ্য আমদানি ও রপ্তানি—দুই–ই কমে গিয়েছিল। আর এবার আমদানিতে ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মোট পণ্য–বাণিজ্যে।

২০২৩ সালের বার্ষিক পণ্য আমদানি কমে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য একাধিক আমদানি নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যার প্রভাব পড়েছে মোট আমদানিতে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্ব পণ্যবাজারে অস্থিরতা তথা দামের হঠাৎ হঠাৎ ওঠানামায় পণ্য আমদানি ব্যয়ের রাশ টানার চেষ্টা ছিল। তৃতীয়ত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদাও কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে, যা পরিলক্ষিত হয় গত বছরের শেষ প্রান্তিকে (যা আবার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকও বটে) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হওয়ায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়কালে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৭৮, যা তার আগের প্রান্তিকে বা জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে ছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

অন্যদিকে সেবা খাতের বাণিজ্যও নিম্নমুখী ছিল গত বছর। সেবা খাত রপ্তানি থেকে আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সেবা আমদানিও কমে গিয়েছিল। ফলে পর্যটন, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সেবা খাতের বাণিজ্যের অর্থমূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলারে, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ২২১ কোটি ডলার।

অবশ্য চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে সার্বিকভাবে পণ্য–বাণিজ্য চাঙা হওয়ার কিছু আভাস মিলেছে। এই সময়কালে (জানুয়ারি-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেড়েছে।

এই সময়ে আমদানিও বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রে প্রথম প্রায় চার মাসে (২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) আমদানি ব্যয় ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়ার তথ্য পাওয়া যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে দেশে শিল্প খাতে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, যা বিনিয়োগ বাড়ার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হওয়ার লক্ষণ।

তবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে গিয়ে পণ্য আমদানিসহ মোট বাণিজ্য কতটা বাড়ে, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে চলতি বছরের বাণিজ্য তথা অর্থনীতি তেজি হয়ে ওঠার বিষয়টি। তার আগপর্যন্ত ডব্লিউটিও ও আঙ্কটাডের মতো সীমিত আশাবাদী থাকতে হচ্ছে।

  • আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক। [email protected]