বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব দৃশ্যত আন্তরিকভাবেই ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করতে চায়। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের বেশ কিছু অতিকথন জনমনে আশার আলো সঞ্চারের বিপরীতে হতাশা ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে।
প্রথমেই বলা হলো, আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানত বিমার পরিমাণ এক লাখ থেকে দ্বিগুণ করে দুই লাখ করল। ছোট আমানতকারীরা আশ্বস্ত হলো।
দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের ব্যাংকিং কার্যক্রম বলতে গেলে অনেক দিন ধরে বন্ধই আছে। তাদের চেক ক্লিয়ারিং হচ্ছে না, বন্ধ রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা কার্যক্রম। রেমিট্যান্স প্রবাহ শূন্যের কোঠায়।
নতুন বিনিয়োগ বন্ধ। ঋণ আদায় নেই বললেই চলে। কারণ, যারা ঋণ নিয়েছে, তারা হয় রাঘববোয়াল এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে অথবা বেনামে নেওয়া ঋণ হিসাবের খাতা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে অনলাইন লেনদেন। অনাস্থায় নতুন কোনো আমানত আসছে না বলেই চলে।
এখন এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা চেক, ডিমান্ড ড্রাফট ইত্যাদি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে। কোনো কোনো শাখায় ব্যাংক কর্মচারীদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে, টাকা ফেরত না পেয়ে কষ্ট ও ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যাচ্ছে।
আমানতকারীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা হুমকির মুখে। তারা তাদের খরচ মেটাতে ও ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলল, তারল্যসংকটে থাকা এরূপ ব্যাংকে আপৎকালীন তারল্য সহায়তা দেবে। তারা সরাসরি টাকা ধার্য দেবে না।
তাতে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে এবং মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে কষ্ট তৈরি করবে। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের পক্ষে গ্যারান্টিপত্র দেবে, যে গ্যারান্টিপত্র দেখিয়ে তারল্যে উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে ওই সব ব্যাংক নগদ তারল্য সহায়তা পাবে।
আপৎকালীন এ তারল্য সহায়তা স্বল্পমেয়াদি হবে এবং এর বিপরীতে সুদ বা মুনাফা দিতে হবে। জনগণ সরল বিশ্বাসে আস্থা রাখলেও এরূপ বন্দোবস্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বেশ কিছু পদ্ধতিগত জটিলতা বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই জানে, ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক তথা সুদি ব্যাংক থেকে ধারকর্জ করতে পারে না। এটি তাদের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংক অন্য কোনো ইসলামী ব্যাংক থেকে কর্জ করতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা, নিকট অতীতের সবচেয়ে সফল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি নিজেই এখন একটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক।
অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের অবস্থাও সঙিন। প্রয়োজন ছিল ইসলামি অর্থবাজার তথা ইসলামি মানি মার্কেটের ব্যবস্থা প্রচলন করা, যা আজ অবধি কোনো সরকারই আমলে নেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নেতৃত্বের উচিত হবে ইসলামি মানি মার্কেট প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ নেওয়া। গ্যারান্টিপত্র ইস্যু করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের তারল্যসংকটের সমাধানের চিন্তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।
প্রথম আলো আয়োজিত সাম্প্রতিক গোলটেবিল বৈঠকে গভর্নরের আহ্বান উদ্বৃত্ত তারল্য থাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইতিমধ্যে সমস্যায় থাকা ব্যাংকে তারল্য সহায়তা ঋণ দিলে তা খেলাপি হতে পারে।
সেই খেলাপি ঋণ উদ্ধারে নিয়ন্ত্রক ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া তাদের জন্য বিব্রতকর। অন্যদিকে বিদেশি অডিট সংস্থা যখন দেখবে, এসব সচ্ছল ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক তথা মন্দ গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে, তখন ওই সব সচ্ছল প্রতিষ্ঠানেরও আন্তর্জাতিক রেটিং খারাপ হতে পারে।
সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের কথায় তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় দেউলিয়াগ্রস্ত যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা মালিকদের অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, নামে–বেনামে ঋণ দিয়ে নিজেরাও লাভবান হয়েছেন, পিএলসি তথা জনগণের প্রতিষ্ঠানকে খাদের কিনারায় নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করেছেন, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের ঘুম হারাম করে পথে বসানোর জোগাড় করেছেন, তাঁরা কীভাবে বহাল তবিয়তে থাকেন?
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রাখঢাক না করেই বলে বেড়াচ্ছে যে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে একত্র করে এক বা একাধিক বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে লক্ষ্যে তারা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী তথা মূলধন সরবরাহকারী খুঁজছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র রয়েছেন, কিন্তু ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী তথা গভর্নর নিজেই এসব বলে বেড়াচ্ছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কোন আইনবলে এসব ব্যাংককে একীভূত করতে চায়? বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ও তপসিলি মর্যাদা দেয়। কিন্তু একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য আইন দরকার।
শুধু তা–ই নয়, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেলে তা দেখার জন্য আলাদা আইন ও আদালত রয়েছেন। সুতরাং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই যে অভিপ্রায়, তার ভিত্তি কী?
আমরা কি ধরে নেব, একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য নতুন আইন করা হবে? সেখানে সংকটে থাকা ব্যাংকের দায়দেনার ভার কে নেবে? লোকবলের কী হবে? আমানত, বিনিয়োগ ও অন্যান্য পরিসম্পদের মূল্যায়ন তথা ভ্যালুয়েশন কীভাবে হবে? কাদের মাধ্যমে হবে?
কথা হচ্ছে, বিগত সরকারের সময়েও আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এরূপ আলোচনা শুনেছি। সদ্য বিদায়ী গভর্নর এমনকি ঘোষণাও দিয়েছিলেন কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংকের একীভূতকরণ হবে।
কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিচ্ছায় এরূপ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। নানা মহল থেকেও এর বিপক্ষে প্রশ্ন উঠেছিল। সুতরাং আগের সরকারের ব্যর্থ প্রশ্ন এখন আবার নতুন করে আসার কারণ কী?
তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব আসার পরই বলেছিলেন যে ব্যাংক লুটপাটকারীরা ছাড় পাবে না। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এ রকম দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং যত দিন যাচ্ছে, জনগণের আমানত তথা ব্যাংক লুটেরা ব্যবসায়ীরা হালে পানি পাওয়া শুরু করেছে।
পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় দেউলিয়াগ্রস্ত যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা মালিকদের অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, নামে–বেনামে ঋণ দিয়ে নিজেরাও লাভবান হয়েছেন, পিএলসি তথা জনগণের প্রতিষ্ঠানকে খাদের কিনারায় নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করেছেন, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের ঘুম হারাম করে পথে বসানোর জোগাড় করেছেন, তাঁরা কীভাবে বহাল তবিয়তে থাকেন?
আজ যদি সংস্কারের মাধ্যমে এসব ব্যাংকের শাখা সংকোচন করা হয়, সে ক্ষেত্রে বহু জনবল ছাঁটাই করতে হবে। ছাঁটাই হওয়া কর্মচারীরা পরিবার নিয়ে পথে বসবেন। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপকেরা আগেই আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা।
চতুর্থত, যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বা তার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কার্যপরিধি, তাতে ব্যত্যয় হয়েছে দিনের পর দিন। একটি ব্যাংকের স্থায়ী তারল্যসংকট রাতারাতি সৃষ্টি হয় না।
বিধিবদ্ধ রিজার্ভে নমনীয়তাই শুধু দেখানো হয়নি, সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে পাহাড়সমান ঘাটতি। বিধিবদ্ধ রিজার্ভের ঘাটতি পূরণে ওই সব ব্যাংককে সতর্ক না করে বরং টাকা ছাপিয়ে ধার দিয়ে তাদের চলতি হিসাবের ঘাটতিকে বাড়তে দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তার দেখভাল করেছে কি?
নাকি অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে? সে ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সর্বোপরি বাংলাদেশি টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কথায় আত্মতুষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে টাকার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষত মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ক্রলিং পেগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত।
বর্তমান পদ্ধতিটি পুরোপুরি ভাসমান, তথা বাজারের চাহিদা ও জোগান দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে না। আবার নিকট অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি এবং তার মূল্য পরিশোধ তথা ব্যালেন্স অব ট্রেড ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্যে বড় বিভ্রাট দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে নিকট অতীতে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যারা অস্বাভাবিক লাভ করেছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে বেকায়দায় ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
হালে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য একটি কমিশন করা হয়েছে। তাদের কর্মপরিধি সীমাহীন না করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তাবনার আলোকে সংস্কারকে এগিয়ে নিতে হবে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কথার চেয়ে কাজে বেশি মনোযোগ দেওয়া, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কষ্ট লাঘবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যর্থ হওয়া যাবে না।
শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক।