আমরা একটা কথা প্রায়ই বলি বা শুনি, ‘এটা তো একটা মীমাংসিত সত্য’ কিংবা ‘একটা মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কেন জল ঘোলা করা হচ্ছে’ ইত্যাদি। তার মানে আমরা ধরেই নিই, কিছু বিষয়ে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এটাই চূড়ান্ত। কিন্তু এখানে ‘আমরা’ কোনো অবিভাজ্য সত্তা নই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশে একটা গৃহবিবাদ চলছে। এর শুরু ১৯৭১ সালে কিংবা তারও আগে।
যা ঘটে গেছে, তার বিবরণই ইতিহাস। ইতিহাসের কালানুক্রমিক বর্ণনা সব ইতিহাসবেত্তা এক রকমভাবে দেন না। একই ঘটনার একাধিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এসব ব্যাখ্যা সাংঘর্ষিকও হতে পারে। ব্রিটিশ রাজনীতিক ও কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নামে একটি কথা চালু আছে, ‘বিজয়ীরাই ইতিহাস লেখে।’ এর অর্থ হলো ঘটনা যা-ই ঘটুক, যিনি বিজয়ী বা ক্ষমতাবান, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে ইতিহাসের বয়ান। ক্ষমতার পালাবদল হলে ইতিহাসের বয়ান পাল্টে যেতে পারে।
কথায় কথায় আমরা বলি, এটা নিয়ে তর্কের কী আছে। এটা তো ইতিহাস। তারপরও তর্ক হয়। কেননা, ইতিহাসের ব্যাখ্যা এক জায়গায় থেমে নেই। সে জন্য অতীতের নানান ঘটনা ও বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। আমরা সবাই ঐকমত্যের কথা বড় গলায় বললেও অনেক বিষয়ে একমত হই না। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি এই বিভাজন তৈরি করে দেয়। আমরা একদিকে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ বলে মতভিন্নতাকে গৌরবান্বিত করি, অন্যদিকে ‘গণতান্ত্রিক-কেন্দ্রিকতার’ দোহাই দিয়ে ভিন্নমতের টুঁটি চেপে ধরি।
১৯৭১ সালের কথাই ধরা যাক। একাত্তরে এ অঞ্চলে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। আমরা কেউ বলি এটা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ; কেউ বলি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরির জন্য ভারতের যুদ্ধ। এটা তো সত্য, অনেক বাঙালি স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। আবার কিছু বাঙালি চাননি। এটাও সত্য যে ভারত পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বিষয়ে এক সেমিনারে নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজের পরিচালক কৃষ্ণস্বামী সুব্রামানিয়াম (তাঁর ছেলে সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর এখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘ধীরে চলা নীতি’র সমালোচনা করে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘এটি ভারতের জন্য এমন সুযোগ এনে দিয়েছে, যা আগে কখনো আসেনি।’ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে চালকের আসনে বসে গিয়েছিল।
ওই সময় এ দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এবং এই যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ ভারতের ‘করদ রাজ্য’ হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেকেই এই মত প্রকাশ করেছেন যে ‘সম্প্রসারণবাদী’ ভারত তাঁবেদার সরকার বসিয়ে বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় পুরেছে। সর্বশেষ উদাহরণও তা-ই, শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছেন আর ভারত তার জাতীয় স্বার্থে চরম অজনপ্রিয় হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনকে সমর্থন দিয়ে গেছে।
এই উদাহরণ টানার অর্থ এই নয় যে মহান মুক্তিযুদ্ধ ভুল ছিল কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার ও পরে নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালানোর মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। বাঙালি শখ করে যুদ্ধে যায়নি।
একাত্তরের ‘বিজয়ীরা’এখন আর ক্ষমতায় নেই। যাঁরা ক্ষমতায়, দৃশ্যত একাত্তর নিয়ে তাঁরা সেন্টিমেন্টাল নন। যেমন আমার আগের প্রজন্ম পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল। ১৯৪৭ নিয়ে তাঁদের আবেগ ছিল। কিন্তু আমার বা আমাদের অনেকের ছিল না। তাই পাকিস্তান ভাঙতে আমাদের অনেকের বুক কাঁপেনি।
পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাঠান নেতা খান আবদুল ওয়ালি খান ও বালুচ নেতা গাউস বখশ বিজেঞ্জোর সামনে কেঁদেছেন। কারণ, তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন। (ইন সার্চ অব সলিউশনস: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব মীর গাউস বখশ বিজেঞ্জো) আবার ‘জেন-জি’র অনেক কিছু আমি বুঝি না। তাঁদের জগৎ আলাদা। তাঁরাও অনেকে একাত্তর নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, যেমন আমি ১৯৪৭ নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে ইতিহাসচর্চার অংশ হিসেবে ১৯৪৭ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন গুরুত্বপূর্ণ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ কিংবা ১৫২৬ সালের পানিপথের যুদ্ধ।
দেশে একটা বড় ধরনের ওলট-পালট হয়েছে। অনেক বছরের অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে। মূল্যস্ফীতির আঘাতে মানুষ জেরবার। এ সময় নানান গোষ্ঠী নানান বায়না বা আবদার নিয়ে মাঠ গরম করছে। এটা চাই, ওটা চাই, দিতে হবে, করতে হবে। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা আগে পড়িনি।
সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতারা কিছু দাবি জানিয়েছেন, আলটিমেটামও দিয়েছেন। তাঁরা ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের আলোকে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? এটা কি সংবিধানের শুরুতে ‘রাষ্ট্রের মূলনীতি’তে প্রতিস্থাপিত হবে, নাকি বাংলাদেশকে নতুন রিপাবলিক ঘোষণা করতে হবে?
বাংলাদেশ তো একটা রিপাবলিক। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ জন্ম নিয়েছে। সরকার আসবে-যাবে। দেশ তো আর নতুন করে হবে না। একাত্তরে যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমাদের দেশ যাত্রা করেছিল, পাঁচ দশক ধরে শাসকেরা সেই জন-আকাঙ্ক্ষাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে পারিবারিক, দলীয় ও গোষ্ঠীগত শাসন জারি রেখেছিলেন। আমরা সেই অবস্থার অবসান চেয়েছি। এই পরিবর্তন যদি সংহত হয়, তাহলে ৫ আগস্ট কিংবা ‘৩৬ জুলাই’ আমরা উদ্যাপন করব।
দেশে একটা বড় ধরনের ওলট-পালট হয়েছে। অনেক বছরের অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে। মূল্যস্ফীতির আঘাতে মানুষ জেরবার। এ সময় নানান গোষ্ঠী নানান বায়না বা আবদার নিয়ে মাঠ গরম করছে। এটা চাই, ওটা চাই, দিতে হবে, করতে হবে। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা আগে পড়িনি।
১৯৭২ সালে মানুষ ধৈর্য ধরে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা প্রতারিত হয়েছিলেন। এর পর থেকে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হচ্ছে শাসকদের ধারাবাহিক প্রতারণার ইতিহাস। মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, দু-চার দিন না পেরোতেই তারা প্রতিশ্রুতি ভুলে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ও পরে তাদের অর্থবিত্তের হিসাব নিলেই এটা বেরিয়ে আসে। মানুষ একবার বিশ্বাস হারালে সেটা ফিরিয়ে আনা খুবই মুশকিল।
কিন্তু এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমরা এখন ‘পরাজিত শত্রু’র তৎপরতা দেখছি, হুংকার শুনছি। বিজয়ী আর বিজেতার এই বৈরী সম্পর্ক ও দ্বান্দ্বিক অবস্থান ১৯৭১ সাল থেকেই চলে আসছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটা দুই ভাগ হয়ে গেছে। এ জন্য একে গৃহযুদ্ধ বলা যেতে পারে। ১৯৭১ সালে সবকিছু মীমাংসিত হয়নি। তখন যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। এই গৃহযুদ্ধের অপরাজনীতি দীর্ঘদিন আমরা দেখেছি ‘জয় বাংলা’ বনাম ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ জিগিরের মধ্য দিয়ে। এখন এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
একদিকে আছে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ মাধ্যমে ২০২৪-পূর্ববর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে নতুন করে শুরু করার আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার; অন্যদিকে আছে পুরোনো কাঠামো বজায় রেখে কিছু মলম মেখে সেটাকেই নতুন করে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
এত দিন এ দেশে যাঁরা রাজনীতি করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, তাঁরা হঠাৎ ফেরেশতা হয়ে যাবেন, এটা মিরাকল মনে হয়। বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, তাঁরা সহজেই হাল ছেড়ে দেবেন—এটা মনে করার কারণ নেই। তাঁদের একটা অনুগত গোষ্ঠী আছে। তাঁদের হাতে অনেক টাকা, আছে অনেক অস্ত্র। সর্বোপরি, তাঁদের পেছনে আছে ভারতের সমর্থন। সুতরাং আরও ঝড়-ঝঞ্ঝার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক