শেখ হাসিনার বিদায় দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বড় শিক্ষা

শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের পিতা এবং দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে—এই ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সপ্তাহে ঢাকার সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণের ছবি ছিল এগুলোই। এই ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলার তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে, দেশটি কেন ও কীভাবে আজকে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। সেই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাণপুরুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। সে সময় তাঁকে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, যা পশ্চিমা সরকারগুলো পছন্দ করেনি।

এ অবস্থার মধ্যে ১৯৭৪ সাল নাগাদ তাঁর জনপ্রিয়তা সাংঘাতিকভাবে কমতে থাকে। বিশেষ করে খরার পর দুর্ভিক্ষের মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল।

আরও পড়ুন

ওই সময়টায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগত মিলিশিয়া (রক্ষী বাহিনী) সবখানে ভীতি সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৫ সালে তিনি সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেন। এর কয়েক মাস পর আগস্ট মাসে ঢাকায় নিজের বাসভবনে তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ তাঁকে হত্যা করা হয়। ওই সময় শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।

১৯৭৫ সালের পরবর্তী সরকারগুলো শেখ মুজিবের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করেছে এবং সে সময়কালে তিনি যেন ইতিহাসের পাদটীকা হয়ে ছিলেন। তবে ১৯৮১ সালে হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং সে সময় তাঁকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ওই সময় তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তিনি বেশ নির্ভীকভাবে সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বিশেষ করে আশির দশকের শুরুতে ক্ষমতায় বসা জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামনে তিনি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে বসেছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধী নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন করেন এবং একপর্যায়ে এরশাদের পতন হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে।

যে কোটা বাতিলের জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, সরকারি চাকরিতে সেই কোটা আওয়ামী লীগ রাখতে চেয়েছিল মূলত তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য। শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে তাঁদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকার’ বলায় এবং তাঁদের ওপর সরকারি দলের লোকজন হামলা করায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল।

১৯৮৬ সালে আমি একজন তরুণ রিপোর্টার হিসেবে বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম এবং সে সময় হাসিনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তিনি আমাকে তাঁর পুরোনো পারিবারিক বাড়িতে নিয়ে গেলেন, যেখানে সিঁড়িটিতে তখনো তাঁর বাবার রক্তের দাগ ছিল। হাসিনা আমাকে সেই বাড়ির চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বাড়িটিকে একটি জাদুঘরে পরিণত করেছিলেন। গত সোমবার উন্মত্ত জনতা সেই বাড়িটি ভাঙচুর করে ভেতরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ তারা মুছে দিয়েছে।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন, ২০০১ সালে হেরে যান এবং ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে গত সোমবার পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনটি নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে ২০১৪ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বয়কট করেছে। ২০১৮ সালে বিরোধীরা অংশ নিলেও ভোটারদের ভয় দেখানো এবং কারচুপির ব্যাপক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা তাদের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

আরও পড়ুন

হাসিনা তাঁর ক্ষমতার প্রথম দিককার বছরগুলোয় দরিদ্রদের অবস্থান উন্নত করতে এবং তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে সময় তৈরি পোশাক রপ্তানি ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সূচকগুলোকে উন্নত করেছে ও দারিদ্র্য হ্রাস করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে দেশটি ‘স্বল্পোন্নত দেশ’-এর মর্যাদা বেরিয়ে আসার পূর্বাভাস রয়েছে। এগুলো বড় অর্জন। তবে হাসিনা তাঁর শাসনকালের শেষ দিকে ভয়ানক কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন।

তাঁর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ফুলে–ফেঁপে উঠতে থাকেন, আমলাতন্ত্রে তিনি এবং পুলিশ বাহিনীর সিনিয়র পদে অনুগতদের নিয়োগ করেছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অদৃশ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা হয় এবং সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, একটি কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে কোটা বাতিলের জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, সরকারি চাকরিতে সেই কোটা আওয়ামী লীগ রাখতে চেয়েছিল মূলত তাদের ঘনিষ্ঠ লোকদের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য। শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে তাঁদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকার’ বলায় এবং তাঁদের ওপর সরকারি দলের লোকজন হামলা করায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল।

সরকারি দলের লোকজনের হামলার পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ২০০ লোক নিহত হওয়ায় আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। ছাত্ররা এরপর সরকারপ্রধানকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু সরকার কোনো ধরনের আপসে না গিয়ে আরও কঠোর হয়। এর ফলে আন্দোলন তীব্র সহিংস হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

ভারতের সাবেক ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্ট বলেছিলেন, ‘আপনি কেন দায়িত্ব ছাড়বেন?—লোকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়; আপনি কেন দায়িত্ব ছাড়ছেন না?—সেই প্রশ্ন ওঠার পরে নয়।’

তবে রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, তাঁরা অজেয়। কেউ তাঁদের ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে না এবং তাঁরা বংশপরম্পরায় ক্ষমতা আগলে থাকতে পারবেন। পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার, নওয়াজ শরিফ পরিবার, ভারতে নেহরু পরিবার, বাংলাদেশে শেখ মুজিব পরিবার এবং জিয়াউর রহমানের পরিবারের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে।

ভোটারদের এই পরিবারতন্ত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এমন নতুন নেতৃত্বে দেশ চালানোর নিরীক্ষায় নামতে হবে, যাঁদের পূর্বপুরুষদের এ ধরনের দায়িত্বে থাকার অভিজ্ঞতাই ছিল না। আশার কথা, মানুষ সেই অন্ধ আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

  • সলিল ত্রিপাঠী ভারতের সাংবাদিক ও ‘দ্য কর্নেল হু উড নট রিপেন্ট: বাংলাদেশ ওয়ার অ্যান্ড ইটস আনকুয়ায়েট লিগেসি’ বইয়ের লেখক

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত