স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়নের কথা বলে আফ্রিকায় যত সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, ততগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনও হয়নি।
গ্যাবনে পুনর্নির্বাচিত নেতার বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে রিপাবলিকান গার্ড অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। ঠিক এক মাস আগে নাইজারে প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় সেনারা ঘটিয়েছেন এমন আরও তিনটি অভ্যুত্থান। এ সবকিছু একটা বিপজ্জনক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে।
সেনাশাসিত বারকিনো ফাসো, মালি ও গিনি যে এসব অভ্যুত্থানের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে, তা কাকতালীয় ঘটনা নয়। পশ্চিম আফ্রিকার এই তিন দেশেই সম্প্রতি অভ্যুত্থান ঘটে। অল্প দিনের জন্য হলেও এই দেশগুলো ‘অভ্যুত্থানের বেল্ট’—এই পরিচিতি এড়াতে পেরেছিল। আগের বছরগুলোয় উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসর, সুদান ও লিবিয়াতেও সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে। ফলে কষ্টার্জিত রাজনৈতিক অগ্রগতি জলে গেছে।
বলাই বাহুল্য, সেনা অভ্যুত্থান বা অসামরিক বিষয়ে নাক গলানোর এসব ঘটনা শুধু আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এই সমস্যা প্রাচীন ও বৈশ্বিক। প্রাচীন রোমে জুলিয়াস সিজারের পর থেকে কোনো না কোনো সময়ে প্রতিটি মহাদেশই এ ধরনের সমস্যায় পড়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোয় উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো সামরিক অভ্যুত্থানে ভুগেছে বেশি। দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার না হলেও শত শত অভ্যুত্থান ঘটেছে। কখনো দেশের ভেতরের শক্তিতেই সামরিক অভ্যুত্থান করেছে, আবার কখনো বহিঃশক্তি তাদের উসকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দেশে সরকারের পতন ঘটেছে সেনা অভ্যুত্থানে।
১৯৫২ সালে মিসরের মতো হাতে গোনা কয়েকটি অভ্যুত্থান দেশগুলোর জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। এর বাইরে বাকি সব অভ্যুত্থান ছিল অনর্থক, যার জন্য তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এগুলো ছিল হয় স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য ‘গার্ডিয়ান ক্যু’। যেমন ১৯৬০-৮০ সাল পর্যন্ত তুরস্কে পরপর তিনটি সেনা অভ্যুত্থান, কিংবা ‘ভেটো ক্যু’, যা কিনা নির্বাচিত জনপ্রিয় সরকার উৎখাত করেছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৭৩ সালে আমেরিকার মদদে চিলির সালভাদর আলেন্দে সরকারকে উৎখাতে যে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার কথা বলা যায়।
সারকথা হলো, অসামরিক সরকারব্যবস্থায় সেনা হস্তক্ষেপের ইতিহাস বিবেচনায় বলা যায়, তাঁদের নাকগলানো থেকে বিরত রাখার কোনো সহজ উপায় নেই। সামরিক অভ্যুত্থানে উসকানি দেওয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দায়ী করা যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পশ্চিমাদের, যেমন ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বহু বছর ধরে অন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া এবং তাদের নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলায় ইন্ধন জুগিয়ে আসছিল।
বেশির ভাগ সেনা অভ্যুত্থানকারী স্বর্গ হাতে এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু আদতে আনেন নরক। তাঁরা শুধু অযোগ্য হন না, তাঁদের পূর্বসূরিদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং সহিংস হয়ে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় অন্তত তা-ই ঘটেছে। অভ্যুত্থানকারীরা সেনাবাহিনীর শীর্ষে নিজেদের অনুগত লোকজনকে বসিয়ে কী করে দশকের পর দশক ক্ষমতা ধরে রাখা যায়, তা-ই নিশ্চিত করেছেন।
অভ্যুত্থান যদি মৌলিক বিবেচনায় এতই ভয়ংকর হয়, তাহলে সেনা কর্মকর্তারা কেন অসামরিক বিষয়ে নাক গলান? আফ্রিকা বা অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো কখনো কখনো তাঁরা বেশ ধুমধাম করেও ক্ষমতা দখল করেন।
পাঁচটি বিষয় এই ঘটনাগুলোর পেছনে কাজ করে থাকে।
প্রথমত, তাঁরা অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপ্লব ঘটাতে না পারলেও, কেবল সেনা কর্মকর্তারাই একটি দেশের ক্ষমতা দখলের ক্ষমতা রাখেন।
দ্বিতীয়ত, কারণ, তাঁরা মনে করেন, অভ্যুত্থানের প্রয়োজন আছে। যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁর কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায় এবং সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয়ত, কারণ, তাঁরা এমন এক কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের মুখোমুখি হন, যাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার বৈধতা ও জনপ্রিয়তা নেই।
চতুর্থত, কারণ, তারা জনগণের অন্তত একটি অংশের সমর্থন পান, যারা মনে করে সেনাবাহিনীই একমাত্র রক্ষাকর্তা, অথবা খারাপ হলেও গভীর জাতীয় সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় শক্তি শুধু তাঁদেরই আছে বলে মনে করে।
সর্বোপরি, দুষ্কর্মের সাথি হিসেবে আঞ্চলিক শক্তিকে পাশে পাওয়া বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার কারণে তাঁরা দায়মুক্তি পাবেন বলে মনে করেন।
দুর্নীতি, দারিদ্র্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, গভীর বিভক্তি, সহিংস উগ্রবাদ একটি রাষ্ট্রকে সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকিতে ফেলে। গ্যাবন ও নাইজার এর উদাহরণ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ গণতন্ত্র এবং সরকারের ওপর আস্থা হারায়, তারা সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দিকেও আর অতটা নজর দেয় না।
আরও গভীরভাবে বলতে, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাবে যেখানে আইনের শাসন, ক্ষমতার ভারসাম্য, জাতিগোত্র-নির্বিশেষে অধিকার ও দায়িত্বের জায়গা থেকে সব মানুষ নিজেকে সমান মনে করে না, সেখানে অভ্যুত্থানকারীরা সুযোগ খুঁজে নেন।
কেন কনোর ও ডেভিড হেভডিচ তাঁদের ব্যঙ্গাত্মক এবং কঠোর ভাষায় লেখা বই কীভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে হয়, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন-এ সেনা অভ্যুত্থান ঘটার ১০টি পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ করেছেন।
এগুলো হলো দেশটি সাবেক কোনো উপনিবেশ বা কোনো দেশের দখলে ছিল কি না; দেশটির অবস্থান গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় কি না; ধর্মীয়, জাতিগত অথবা গোত্রগত বিভক্তি; যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে তেল, ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি; দীর্ঘ মেয়াদে স্বৈরাচারী সরকার, বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, ভাড়াটে সৈনিকদের পেছনে যথেষ্ট অর্থায়ন এবং অতীতে কখনো অভ্যুত্থান হয়েছে কি না।
সারকথা হলো, অসামরিক সরকারব্যবস্থায় সেনা হস্তক্ষেপের ইতিহাস বিবেচনায় বলা যায়, তাঁদের নাকগলানো থেকে বিরত রাখার কোনো সহজ উপায় নেই। সামরিক অভ্যুত্থানে উসকানি দেওয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দায়ী করা যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পশ্চিমাদের, যেমন ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বহু বছর ধরে অন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া এবং তাদের নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলায় ইন্ধন জুগিয়ে আসছিল।
দিন শেষে বলতে হয়, অভ্যুত্থানের উত্থান হয় ভেতর থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার বেহালের সুযোগ নিয়ে। আর উল্টোটাও সত্য। একটি ভালো, সুস্থ, স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এ ধরনের অভ্যুত্থানকে প্রতিহত এবং একই সঙ্গে বিদেশি শক্তির সঙ্গেও ন্যায়সংগত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ
আলজাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত