রাজপথের ডান্ডাবাজ

কয়েক দিন আগের কথা। আমার ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের মাথায় (মিরপুর রোডের সঙ্গে সংযোগস্থল) এসে গাড়ি নিশ্চল হয়ে পড়ে পুলিশের বাধায়। অনেকক্ষণ যায়, আমার পেছনে আরও অনেক গাড়ি আর রিকশা জমতে থাকে ধীরে ধীরে। সামনের মিরপুর রোডে যানবাহন নেই কোনো, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওয়্যারলেসে কথা বলছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট আর দূরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যেন কারও অপেক্ষায়!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় ফিরে এসে অন্য সন্তানকে আনার জন্য আবার আমাকে ধানমন্ডিতে আসতে হবে গাড়ি নিয়ে। দেরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাই বারবার সময় দেখি। পথ রোধ করে দাঁড়ানো পুলিশকে জিজ্ঞেস করে শুনি, ভিআইপির গাড়ি যাবে, তাই এতক্ষণ ধরে বাকি সব গাড়ি আর রিকশার পথ রোধ করে রাখছেন তাঁরা। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি, এমন সময় হুইসেল বাজাতে বাজাতে ভিআইপির অতিকায় গাড়িবহর অতিক্রম করে আমাদের সামনে দিয়ে।

আগে-পেছনে পুলিশের ট্রাক। সেখান থেকে যত দূর সম্ভব হাত প্রসারিত করে আমাদের আমজনতাকে কাছে না আসার জন্য শাসাচ্ছে পুলিশ। তাদের হাতে মোটা লাঠি, পাবলিককে সেই লাঠি ভালো করে দেখানোর জন্য সামনের দিক লাল রং করা। ভিআইপিকে বহনের জন্য তীব্র বাঁশি বাজিয়ে, লাল লাঠি নাচিয়ে যেন এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তারা!

এই অসভ্য দৃশ্য সহ্য হয় না আমার। চোখ নিচু করে রাখি। হঠাৎ শুনি, আমার সাত বছরের কন্যার প্রশ্ন, ‘বাবা, লাঠি দেখাচ্ছে কেন আমাদের?’ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। তাকে কী উত্তর দেব আমি? অন্য দিন হয়তো আমাদের গাড়ি ভিড়ের পেছনে থাকে, লাঠি লক্ষ করে না সে। আজকে তাকে কী বলে বোঝাব আমি?

লাঠিওয়ালারা চলে যাওয়ার পরও জায়গায় জায়গায় আটকে থাকি তাদেরই সৃষ্ট অসহনীয় ট্রাফিক জ্যামে। আমার বুকে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে আমারই শিশুকন্যার প্রশ্ন। কেন আমাদের শিশুদের, বৃদ্ধদের বা অসুস্থ মানুষদেরও লাঠি দিয়ে এভাবে শাসাতে শাসাতে চলাচল করেন ভিআইপিরা? কেন তাঁদের জন্য এভাবে আটকে থাকতে হয় আমাদের? এমন কতজন ভিআইপি আছেন এখন এ দেশে? কোন অধিকারবলে, কোন আইনবলে এভাবে চলাচল করেন তাঁরা? কত কর্মঘণ্টা আর জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, কত মানুষের কত ধরনের দুর্ভোগ হচ্ছে এতে?

২.

আমি জানি, আমাদের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী (এবং বিদেশি সরকারপ্রধানদের) নিরাপত্তার প্রশ্ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা প্রটোকল হিসেবে তাঁদের চলাচল করার সময় অন্যান্য যান আটকে রাখা হয়তো অসংগত নয়। তবু ট্রাফিক জ্যামের অসহনীয় পরিস্থিতি এবং এর মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য বিবেচনায় রাস্তায় চলাচল কমানো বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করার মতো বিকল্প ভাবতে পারেন তাঁরা।

বাকি যাঁরা আছেন, তাঁরা কোন যুক্তিতে পুরো শহরের মানুষকে অবরুদ্ধ রেখে চলাচল করেন রাজপথে? শুধু নানা স্তরের মন্ত্রীরা নন, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন বাহিনীর কর্তারাও এভাবে এখন চলাচল করেন রাস্তাঘাটে। দিনে দিনে তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু আমার চলাচলের সময়ই সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এভাবে রাস্তায় আটকে থাকতে দেখি মানুষকে। সারা দিনে নিশ্চয়ই তাহলে আরও বহুবার এসব ভিআইপির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল থাকতে হয় মানুষকে।

আরও পড়ুন

এই অরাজকতার আসলে কোনো যুক্তি নেই। আমাদের সংবিধান অনুসারে মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা আর বাহিনীপ্রধানেরা হচ্ছেন জনগণের সেবক। সেখানে ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ সংবিধান অনুসারে তাঁরা সেবক আর আমজনতা হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক (সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৭ অনুচ্ছেদ)। এই জনগণকে সেবা করার জন্য তাঁদেরই করের টাকায় সরকারের মন্ত্রী আর কর্মকর্তাদের বেতন, বাড়ি-গাড়ি-ভাতার সংস্থান হয়। তাহলে সেবক মালিককে লাঠি উঁচিয়ে, আটকে রেখে কেন চলবেন পথে? সেবকের আচরণ কেন হবে প্রভুর মতো?

সংবিধান জনগণকে অবাধ চলাচলের অধিকারও দিয়েছে সারা বাংলাদেশে। এই অধিকারের ওপর শুধু জনস্বার্থে আইন দ্বারা যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করা যায়। ঢালাওভাবে ভিআইপিদের সুবিধার জন্য জনগণের চলাচলের অধিকার বন্ধ করে রাখার কোনো আইন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। যদি থাকেও এমন আইন, তা অবশ্যই বাতিলযোগ্য জঘন্য একটি আইন। কারণ, মালিককে লাঠি উঁচিয়ে আটকে রেখে সেবক চলাচল করবেন, এটি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হতে পারে না, জনস্বার্থে তো নয়ই।

আমি জানি তাঁরা হয়তো বলবেন, তাঁদের সময় বাঁচাতে অন্যের চলাচল আটকে রাখা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কার সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এটা কীভাবে নির্ধারিত হবে? একজন ভিআইপির সময় একজন মুমূর্ষু রোগী বা স্কুলযাত্রী শিশুর সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, বড় বড় শহরে অসহনীয় যানজটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে নগর-পরিকল্পনায় তাঁদেরই বিভিন্ন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে।

জনগণের কোনো দায় নেই এতে। তাঁদের পাপের প্রতিফল তাহলে সাধারণ মানুষ কেন ভোগ করবেন রাজপথে বন্দী হয়ে থেকে? আমার জানামতে, এই অরাজকতা হয় না পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে। কোথাও ভিআইপিদের দ্রুত চলাচল নিশ্চিত করার জন্য সাধারণ জনগণের যানবাহনগুলো সম্পূর্ণভাবে থামিয়ে রাখা হয় না।

পৃথিবীর উন্নত দেশে যান চলাচলে অগ্রাধিকার পায় বরং অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস বা শিশুদের স্কুলবাস; কোনো ‘ভিআইপি’ নামধারী নন, রাষ্ট্রের কোনো কর্মচারী নন।

৩.

শুধু রাস্তা আটকে নয়, ভিআইপির আরও বিভিন্ন দৌরাত্ম্য আমরা লক্ষ করি রাস্তায়, নৌপথে, বিমানপথে। আমাদের মনে আছে, একবার এক যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার গাড়ি বহন করার জন্য নদীপথের ফেরি অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা। ফেরিঘাটে অপেক্ষমাণ একজন অসুস্থ ছাত্র মারা যায়। এরপর জানা যায়, এভাবে ফেরি অপেক্ষমাণ রাখার কোনো আইনগত অধিকার ছিল না সেই কর্মকর্তার। আমাদের ছাত্ররা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করার সময় দেখা গিয়েছিল, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে উল্টো পথে চলাচল করেন বহু ভিআইপি ও ভিআইপি নামধারী ব্যক্তি। আরেকবার বিমানপথে বেআইনিভাবে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের দাবি তুলে তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন আরেক ‘ভিআইপি’।

এমন বহু ঘটনা পত্রিকায় আসে, অনেক ঘটনা হয়তো আমরা জানতেই পারি না। দেশ চালানোর দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা এভাবেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন প্রকাশ্যে। এতই তা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও যেন ভুলে গেছি। কিন্তু আমাদের আগামী প্রজন্মের চোখে পড়ে এসব, তিক্ত প্রশ্ন জাগে বুকে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় তাই তারা আটকে দিয়েছিল এসব ভিআইপির দৌরাত্ম্য। সবচেয়ে আগে চলতে দিয়েছিল অসুস্থ মানুষের অ্যাম্বুলেন্সকে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিশু-কিশোরদের পিটিয়ে আর মামলা দিয়ে দমন করেছেন ভিআইপি এবং তাঁদের আজ্ঞাবহরা। কিন্তু তাদের বুকের ভেতরের জ্বলজ্বলে বহু প্রশ্নের কোনো নিরসন হয়নি। রাষ্ট্র মেরামতের যে দাবি তারা তুলেছিল, আমারই শিশুকন্যার প্রশ্নে আবারও মনে পড়ে তা। কবে হবে এই রাষ্ট্রের মেরামত? কবে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা হবেন জনগণের সেবক? কবে রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্মান আর শ্রদ্ধা দেখাতে শিখবেন তাঁরা?

আরও পড়ুন

৪.

অর্থনৈতিকভাবে খুব সংকটময় সময় অতিবাহিত করছি আমরা। নানাভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশ ও অনুরোধ জানানো হচ্ছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। এমন একটা সময়ে ভিআইপিদের রাস্তায় চলাচলকালে যানজট থেকে সাধারণ মানুষের যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও কর্মঘণ্টা অপচয় ঘটে, তা সরকারের বিবেচনা করা উচিত। তাঁদের চলাফেরার সময় যে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি ও লোকবলের সুবিধা নিয়ে থাকেন, তা আইন বা যুক্তিসম্মত কি না, সেটিও ভেবে দেখা প্রয়োজন।

একটা দেশে নিজের চলাচলের সুবিধার জন্য অন্য সবাইকে আটকে রাখা আর যা-ই হোক নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও মানবাধিকারের বিবেচনায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক