বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। চার বছর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে সিএএ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে বিস্মিত তিনি বলেছিলেন, ‘বুঝতে পারছি না, ভারত কেন এটা করল! এই আইনের কোনো প্রয়োজন ছিল না!’ চার বছর ধরে বিস্তর টালবাহানার পর এখন ওই আইন চালু করার উদ্দেশ্য ও তাগিদ যে হরিলুটের বাতাসার মতো লোকসভার ভোট কুড়ানো, সেটাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ‘না বোঝা’ প্রশ্নের একমাত্র অকৃত্রিম উত্তর।
এই মুহূর্তে ভারতের সর্বত্র এটাই প্রধান আলোচ্য বিষয়। যদিও সেই সঙ্গে ঝরছে বহু জিজ্ঞাসা। বহু প্রশ্ন। মনে জাগছে হাজারটা খটকা। হামাগুড়ি দিচ্ছে অদ্ভুত সন্দেহ, শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হবে না তো? সত্যি বলতে কি, কারও কাছে কোনো উত্তরই নেই। সরকারও নিরুত্তর!
সিএএর মোদ্দা ব্যাপারটা কী, সে নিয়ে কারও মনে কোনো জিজ্ঞাসা অবশ্য নেই। কারণ, এত দিনে সবার জানা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বিতাড়িত হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিষ্টান, জৈন ও পার্সিদের ভারত নাগরিকত্ব দেবে। কারা তা পাবেন?
যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে চলে এসেছেন এবং পাঁচ বছর ধরে বসবাস করেছেন। নাগরিকত্বের সেই অধিকারের জন্য শরণার্থীদের কী কী করতে হবে, সরকার এবার সেটাই জানিয়ে দিল। ৩৯ পৃষ্ঠার এক বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। চিন্তা ও দুশ্চিন্তার জন্ম সেখানেই।
প্রথম চিন্তা, যেসব নথি চাওয়া হয়েছে, সেগুলো জোগাড় কীভাবে করা যাবে? অত্যাচারের শিকার হয়ে ঘটিবাটি হারিয়ে যাঁরা চলে এসেছেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে এখন থেকেই। কারণ, ওই তিন দেশে তাঁরা যে থাকতেন, একসময় সেখানকার নাগরিক ছিলেন, কাগজ না থাকলে কী করে তার প্রমাণ দেবেন?
দ্বিতীয় চিন্তা ঠিক কোনো সময়ে তাঁরা ভারতে এসেছেন ও বসবাস করছেন, সেই নথি পেশ করা নিয়ে। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো নথি রাখা হয়েছে। কিন্তু কার জন্য কোনগুলো প্রযোজ্য, তা বোঝা বেশ ঝক্কির। কোনো রাজ্য সরকার যাতে বাগড়া না দিতে পারে, সে জন্য ঠিক হয়েছে, আবেদন গৃহীত হবে শুধু অনলাইনে। আনা হবে বিশেষ অ্যাপও।
হ্যাপা বা চিন্তার শেষ এখানেই নয়; অনলাইনে পেশ করা আবেদনপত্র ঠিক থাকলে সব নথি নিয়ে আবেদনকারীকে প্রথমে হাজির হতে হবে জেলা কমিটির কাছে। তারা ওই আবেদনপত্র যাচাই করবে। সেখানে সবাই যে উতরে যাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। উতরানোর পর আবেদনকারীকে ঢুকতে হবে পরের ধাপে। যেতে হবে রাজ্য পর্যায়ে গঠিত কমিটির কাছে। সেখানে উতরে গেলেই নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট। বুক ফুলিয়ে আবেদনকারী বলতে পারবেন, তিনি ভারতীয় নাগরিক।
মোক্ষম প্রশ্নটা এখানেই। এবং সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে দুশ্চিন্তার গন্ধমাদন।
আবেদনপত্র যাচাই করার মোট কমিটি দুটি। প্রথমটি জেলা স্তরে, দ্বিতীয়টি রাজ্য পর্যায়ে। কমিটি কারও আবেদনপত্র খারিজ করলে কী হবে, তার কোনো দিশা বিজ্ঞপ্তিতে নেই। এই না থাকার অর্থ অনেক কিছু।
যেমন প্রশ্ন উঠছে, আজ যিনি নাগরিকত্ব না পেয়েও আর পাঁচজন নাগরিকের মতো বসবাস করছেন, ভোটার কার্ডে ভোট দিচ্ছেন, রেশন কার্ডে খাবার পাচ্ছেন, চাকরি করছেন, ব্যাংকের খাতা খুলেছেন, আধার কার্ডও (জাতীয় পরিচয়পত্র) জোগাড় করেছেন, এককথায় নাগরিকত্বের শংসাপত্র ছাড়া মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটের জীবন কাটাচ্ছেন, আবেদন খারিজ হলে তিনি কি সেসব সুবিধা ভোগ করতে পারবেন? কিংবা নতুন করে আরও একবার আবেদন জানানোর অধিকার পাবেন? বিজ্ঞপ্তিতে এর উত্তর নেই।
এর চেয়েও বড় বিপদ একেবারে গোড়ায়। নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন জানানো ও হলফনামা জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে আবেদনকারীকে প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হচ্ছে, তিনি ভারতীয় নাগরিক নন। অনুপ্রবেশকারী। এই স্বীকারোক্তি থেকে যেসব প্রশ্নের উদয়, সেগুলো খুবই বিরক্তিকর। যেমন অনুপ্রবেশকারী যখন-তখন ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড কী করে পেলেন?
কেউ সরকারি কর্মচারী হলে তাঁর চাকরি বিপন্ন হবে কি না—এটাও এক মোক্ষম প্রশ্ন। হেনস্তা হতে হবে কি না, তা-ও অজানা। হলফনামাসহ জমা দেওয়া আবেদনপত্র খারিজ হলে তাঁকে ‘বিদেশি’ আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ও অনুচ্চারিত। কেন্দ্রীয় সরকার শুধু বলেছে, ওই তিন দেশের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ভারতের নেই। এখন নেই ঠিকই, কিন্তু চুক্তি হতে কতক্ষণ?
রয়েছে আরও উত্তরহীন জিজ্ঞাসা। যেমন যদি ধরা যায় কয়েক হাজার মানুষের আবেদনপত্র বাতিল হলো, তখন তাঁদের কোথায় রাখা হবে? তাঁদের জন্য কি রাজ্যে রাজ্যে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ তৈরি হবে? যেমন হয়েছে আসামে?
এই ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নিয়েও সরকারের কোনো বিবৃতি বিশ্বাসযোগ্য কি? সংশয়ের কারণ একেক সময়ে সরকারের একেক রকমের বক্তব্য। ২০১৯ সালে দিল্লির রামলীলা ময়দানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কোনো মুসলমানকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়নি। দেশে তেমন কোনো শিবিরই নেই। অথচ ঘটনা হলো, আসামে তেমন অস্থায়ী শিবির আগে থেকেই চলছিল।
গুয়াহাটি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় ২৫ একর জমিতে ৩ হাজার মানুষকে রাখার মতো স্থায়ী শিবির তৈরির কাজ ২০১৮ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। অথচ ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে সব ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন।
সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়েও। মোদি যখন বলছিলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় এনআরসি নিয়ে আলোচনাই হয়নি, তখন তাঁর ‘ম্যান ফ্রাইডে’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশবাসীকে ‘সিএএ ও এনআরসির’ ঘটনাক্রম বা ‘ক্রনোলজি’ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, প্রথমে সিএএ আসবে, তারপর এনআরসি। ঘাড়ের ওপর যাঁদের নাগরিকত্বের খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কী করে তাঁরা সরকারকে বিশ্বাস করবেন?
চার বছর অপেক্ষার পর লোকসভা ভোটের তফসিল বা সময়সূচি প্রকাশের ঠিক আগে সিএএ চালু করার প্রয়োজন বা তাগিদ কেন পড়ল তা অনুমান করা জলবৎ তরলং। ২০১৯ সালে কী কারণে দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছিল, সবার জানা। দিল্লিসহ জায়গায় জায়গায় কেন দাঙ্গা বেঁধেছিল, তা-ও সবার জানা।
কেন এই আইনকে সংবিধানের পরিপন্থী বলা হচ্ছে, কেন বলা হচ্ছে সরকার নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বৈষম্য দেখাতে পারে না, কেনই-বা বলা হচ্ছে এই আইন বিচার বিভাগের চোখে বৈধ বলে স্বীকৃতি পেতে পারে না, তা-ও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মেরুকরণ ঘটানো হয়েছিল পুলওয়ামা-বালাকোট দিয়ে। ২০২৪ সালের ভোটের আগে সিএএ সেই মেরুকরণের অনুঘটক হতে চলেছে বলে বিরোধীদের বদ্ধমূল ধারণা।
দেশজুড়ে প্রচার চলছে ‘মোদি কি গ্যারান্টির’। অর্থাৎ গ্যারান্টি পূর্ণ করার গ্যারান্টি। সিএএ চালু করাও বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল। বিজেপির সরকার তা পূর্ণ করল। কতটা সার্থক তা হতে পারবে, সুপ্রিম কোর্ট কোনো এক দিন নির্বাচনী বন্ড খারিজ করার মতো এই আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করবেন কি না, জানা নেই। যদিও এটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছে, উত্তরহীন জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও সিএএ হতে চলেছে বিজেপির ভোট জয়ের তুরুপের তাস।
আইনটির প্রয়োজন কোথায়, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা নিশ্চয় এখন তা অনুধাবন করছেন।
● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি