বিশ্লেষণ
জনপ্রশাসন সংস্কারের চ্যালেঞ্জ, মতবিরোধ ও সমাধান
গণ–অভ্যুত্থান শুধু বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং সরকারের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধেও এটি একটি সোচ্চার প্রতিক্রিয়া। এ রকম প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন সংস্কারের চ্যালেঞ্জ, মতবিরোধ ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে লিখেছেন সৈয়দা লাসনা কবীর, এস কে তৌফিক হক ও মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল
দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনমুখী প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের অক্টোবর মাসে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সুপারিশমালা চূড়ান্তভাবে উপস্থাপন করা। তবে এখন পর্যন্ত কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এই বিলম্বের পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ, যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন ক্যাডারের আপত্তির মুখে পড়েছে।
মূলত তিনটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ক্যাডার, অন্য ২৫টি ক্যাডার ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মধ্যে ত্রিমুখী মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। সুপারিশগুলো হলো: ১. উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ২৫টি ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ নিয়োগ; ২. উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক; ৩. স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার হিসেবে না রাখা।
সংস্কারপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষ আশঙ্কা করছেন যে এই মতবিরোধের কারণে যদি সংস্কারপ্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়, তবে দেশ আবার দুর্নীতি ও অপশাসনের বেড়াজালে আটকে পড়বে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রশাসন ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে সমন্বয়সাধন এবং ওই সুপারিশগুলো নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করা জরুরি।
উপসচিব পদে ৫০: ৫০ কোটা কতটা কার্যকর
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোয় উপসচিব পদে পদোন্নতির পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক বর্তমানে নতুন মাত্রা পেয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যখন প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে ৫০: ৫০ কোটা প্রস্তাব করে, তখন তা উভয় পক্ষেই বিরোধের জন্ম দেয়। প্রশাসন ক্যাডার মনে করে, ঐতিহাসিকভাবে উপসচিব পদ বরাবরই তাদের ছিল। অন্যদিকে অন্য ক্যাডারগুলো দাবি করে, মন্ত্রণালয়ের কাজের ধরন অনুযায়ী তাদেরও এ পদে সমান অংশীদারত্ব থাকা উচিত।
প্রশাসন ক্যাডারদের মতে, উপমহাদেশে ক্যাডার সার্ভিসের ইতিহাসে উপসচিব পদ মূলত প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ছিল। ১৯৯২ সালে সেক্রেটারিয়েট ও প্রশাসন ক্যাডার একীভূত হওয়ার ফলে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রশাসন ক্যাডারের আওতায় আসে। তাদের আরও দাবি, ১৯৯৮ সালের নীতিমালা অনুসারে ২৫ শতাংশ পদ অন্য ক্যাডারদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা ছিল কোটা আন্দোলনের ভাবনার পরিপন্থী।
অন্যদিকে অন্য ২৫টি ক্যাডার মনে করে, মন্ত্রণালয়ের কাজের ধরন অনুযায়ী তাদেরও সমান অংশগ্রহণ থাকা উচিত। তাদের বক্তব্য, ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয়/উপসচিব পদ তার’। সংবিধানের ২৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সব নাগরিকের সমান সুযোগের অধিকার রয়েছে। তাই শুধু প্রশাসন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া—এই সমতার নীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।
এই বিতর্কের জেরে ২০০১ সালে বিভিন্ন ক্যাডারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করা হয়। ২০১০ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ এই মামলার রায়ে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১৯৯৮ সালের নীতিমালার মাধ্যমে প্রস্তাবিত প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থাকে বহাল রাখে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ৫০: ৫০ কোটাপ্রস্তাব আগের এই আদালতের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কমিশন যদি এ বিষয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, তবে তা আইনি জটিলতায় পড়তে পারে।
উপসচিব পদে ৫০: ৫০ কোটাপ্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর কার্যকারিতা ও সম্ভাব্য ফলাফল। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো—যেমন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাজ্যে—পদোন্নতির ক্ষেত্রে এমন কোনো কোটাব্যবস্থার প্রচলন নেই। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই প্রশাসনিক কাঠামোর ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডারকে একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত উপসচিব পদে নিয়োগ প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়। তবে প্রয়োজনে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়ে থাকে।
অন্যদিকে উপসচিব পদের দায়িত্ব মূলত নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বস্তবায়ন। এ কাজের জন্য প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা, অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেন। কারণ, সরকারের বেশির ভাগ নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁদের ওপর বর্তায়। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তারাও মন্ত্রণালয়ের নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষ করে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ওপর ছেড়ে দিলে যথাযথ ফলাফল না–ও আসতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ক্যাডারদের উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিশ্চিত করে, প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও মন্ত্রণালয়ের নীতি প্রণয়নে সম্পৃক্ত করার সুযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ প্রক্রিয়ায় ক্যাডারভিত্তিক কোটার পরিবর্তে কর্মকর্তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পেশাগত যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও কার্যক্রমের ধরন অনুযায়ী যখন যে ক্যাডারের জনবল প্রয়োজন, সে অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগ নিশ্চিত করা হলে কাজের গুণগত মান ও কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে আশা করা যায়।
পদোন্নতিতে পরীক্ষা, না অভিজ্ঞতা?
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের উপসচিব পদে পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তনের পরিকল্পনা নতুন জটিলতার জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত বিশ্বজুড়ে সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো ক্যাডারে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। যদি পদোন্নতির জন্য এমন পরীক্ষাপদ্ধতি শুধু প্রশাসন ক্যাডারে প্রবর্তন করা হয়, তবে এটি প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বৈষম্যমূলক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সরকারি চাকরিজীবীদের মূল দায়িত্ব জনগণের সেবা প্রদান। একবার মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে প্রবেশের পর যদি পদোন্নতির জন্য আবার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনের চেয়ে পড়াশোনার ওপর বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করবেন।
এই পদ্ধতির আরেকটি বড় সমস্যা হলো আন্তক্যাডার বৈষম্য। সরকারি চাকরির বিভিন্ন ক্যাডারে কাজের চাপের ধরন এক রকম নয়। কিছু ক্যাডারে কাজের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি, আবার কিছু ক্যাডারে কম। পরীক্ষার জন্য সময় ও সুযোগের এই বৈষম্য ক্যাডারগুলোর মধ্যে আরও বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এমন ব্যবস্থা চালু করা, যার মাধ্যমে সরকারি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়। কর্মকর্তাদের অফিসের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে পড়াশোনার টেবিলে বসানো সংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। তবে দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য একটি প্রমাণনির্ভর পদ্ধতি গড়ে তোলা উচিত, যার মাধ্যমে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যা করণীয়
গণ–অভ্যুত্থান শুধু বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং সরকারের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধেও এটি একটি সোচ্চার প্রতিক্রিয়া। এই বাস্তবতায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রশাসনের দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর কার্যকর সমাধান বের করা। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রশাসনে জবাবদিহি বৃদ্ধি।
বর্তমানে প্রশাসনে কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের যে পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, তা অনেকটাই উপনিবেশ আমলের মার্জিত রূপ। এই পদ্ধতিতে কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতার চেয়ে তাঁদের ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্টি অর্জন বেশি গুরুত্ব পায়। গোপন প্রতিবেদনের (এসিআর) মাধ্যমে কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে ‘বসনির্ভর’ সংস্কৃতি তৈরি করে। এতে অনেক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের চেয়ে তোষামোদির দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই কাঠামো কর্মদক্ষতা বাড়ানোর পরিবর্তে প্রশাসনে অনুৎপাদনশীলতা ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ তৈরি করে।
জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেকেই ‘৩৬০ ডিগ্রি’ মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বললেও এই মুহূর্তে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এর পরিবর্তে দক্ষতা ও সততা নিরূপণের জন্য একটি প্রমাণনির্ভর রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। বাস্তবতা হলো, জনগণ রাজনীতিবিদ কিংবা প্রশাসনের কাছে সেভাবে মূল্যায়িত হন না। রাজনীতিবিদেরা ভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহি করলেও সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো সিস্টেম চালু হয়নি।
ফলে সংস্কারের একটি জরুরি পদক্ষেপ হতে পারে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা, যেখানে জনগণ সরকারি অফিস, সেবা কিংবা কর্মকর্তাদের সম্পর্কে মতামত প্রদান করতে পারবেন। দুর্নীতি বা দায়িত্বে অবহেলার সঙ্গে জড়িত কোনো কর্মকর্তার বিষয়ে এই মাধ্যমে তথ্য পাওয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি আন্তরিক ও দক্ষ কর্মকর্তাদের কাজের স্বীকৃতিও প্রদান করা যাবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। দলীয়করণ আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা। একদিকে রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেন, অন্যদিকে কর্মকর্তারাও পদোন্নতি বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় এই চর্চায় জড়িয়ে পড়েন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের উচিত এই বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা, যেখানে এমপি, মন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার প্রশাসনের সঙ্গে কর্মকর্তাদের কাজের সমন্বয় থাকবে; তবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করবে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তদবির বা চাপকে নিরুৎসাহিত করতে ২০১৮ সালের সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের সংশোধনী এনে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ একটি অপরিহার্য বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার জটিলতা ও জনগণের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সীমিত সম্পদের মধ্যেও এই চাহিদা পূরণ করা প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবিলার জন্য সব কটি ক্যাডারের সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারদের মধ্যে যাতে দূরত্ব সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য সব ক্যাডারের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতির একটি সুষম ও যৌক্তিক রূপরেখা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বর্তমানে দেখা যায়, যেসব ক্যাডারে লোকবল কম, সেখানে দ্রুত পদোন্নতি সম্ভব হচ্ছে। অথচ যেসব ক্যাডারে লোকবল বেশি, সেখানকার কর্মকর্তারা যথাসময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন না।
এ পরিস্থিতি নিরসনের জন্য কাজের ধরন ও পদ্ধতির সাদৃশ্য থাকা ক্যাডারগুলোকে একত্র করে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশনের (পিএআরসি ২০০০) সুপারিশ অনুযায়ী প্রফেশনাল ক্লাস্টার গঠন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে একই ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত ক্যাডারদের একই সময়ে পদোন্নতি দিয়ে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
বৈষম্য দূরীকরণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডারকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকা। অতীতে স্বৈরাচারী শাসনামলে কিছু ক্যাডারকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার হীন চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর ফলে আন্তক্যাডার বৈষম্য ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আগামীর বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এসব সুপারিশ কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করলে হবে না; বরং জনগণ, রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত এতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একটিমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবসম্মত সুপারিশমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এস কে তৌফিক হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।