সপ্তাহখানেক হয় দেশে এসেছি। এর মধ্যে গিয়েছিলাম ব্যাংকে। ব্যাংকের ক্যাশ-কাউন্টারে বসা ভদ্রমহিলা ভীষণ বিরক্তি নিয়ে দুটো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন এসেছেন?’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, ভদ্রমহিলা এত বিরক্ত কেন! খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল, আপনার জীবনে কি ভয়ানক কোনো ঘটনা ঘটে গিয়েছে? এরপর গেলাম আরেক ব্যাংকে। সেখানকার প্রথম ডেস্কে বসে থাকা ভদ্রলোক আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন, আমার মনে হলো, তিনি আমাকে বলতে চাইছেন, আপনার সাতকপালের ভাগ্য, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি!
ব্যাংক থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়েছি। চালক এত দ্রুত চালাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি অ্যাক্সিডেন্ট করবেন। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, একটু আস্তে চালান। তিনি পেছন দিকে ফিরে আমাকে বললেন, ‘আমি তো আস্তেই চালাচ্ছি। আপনার দরকার হয় হেঁটে যান।’ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, একটা শহরের মানুষ এত অস্থিরতা ও বিরক্তি নিয়ে বেঁচে আছে কী করে?
পরদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদের পূর্ব নাখালপাড়ায় হাঁটতে বের হয়েছি। সরু গলির মাঝে ওয়েল্ডিংয়ের দোকান। লোকজন দোকানের ভেতরে কাজ না করে রাস্তা অর্ধেক দখল করে কাজ করছে। আগুনের ফুলকা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ছে রাস্তার চারদিকে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী করে এই রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে যাব। অথচ আশপাশের মানুষকে দেখে মনে হলো, এ আর এমনকি! সবাই সে আগুনের ফুলকার মাঝ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে। কারও গায়েও লেগে যাচ্ছে! এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। বাসায় এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এলাকার কেউ কিছু বলছে না কেন? রাস্তা দখল করে এভাবে কাজ করছে।
এটি তো ঠিক নয়।’ এর উত্তর হচ্ছে, মালিকের ক্ষমতা অনেক। কারও কিছু বলার নেই।
ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলায় যাব। কর্মদিবসগুলোয় এমনিতেই ঢাকা শহরে অনেক জ্যাম। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শুক্রবার যাব বইমেলায়। রওনা হয়েছি বিকেল চারটায়। মাঝপথে এসে গাড়ি আটকে গিয়েছে! একটুও এগোচ্ছে না! আধা ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। আমরা একই জায়গায় আটকে আছি। এদিকে আমার প্রকাশক অপেক্ষা করছে মেলায়। বারবার ফোন দিচ্ছে। ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে গাড়ি চলে না!’ শেষমেশ ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘শুক্রবারও এমন জ্যাম কেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘ভিআইপি যাচ্ছে এই রাস্তা দিয়ে।’ এরও প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমরা একই রাস্তাতেই আটকে ছিলাম। শেষমেশ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে যখন বইমেলায় পৌঁছেছি, ততক্ষণে আমি ঘেমেনেয়ে একাকার!
পরদিন ঢাকা শহরে ধুলোবালু আর শব্দকে মাথায় নিয়েই গেলাম বেইলি রোডে। বাসার সবাই বলছিল, দেশে এসে বেইলি রোডের স্ট্রিট ফুড না খেলে নাকি আমার দেশে আশাই বৃথা! সেখানে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘চিজ মমো’ আর ‘লুচি’ খেলাম। পরের দিন ভোর থেকে আমার পেট এমনই খারাপ হয়েছে যে মনে হচ্ছিল বাথরুমটাকে আমার বেডরুম বানিয়ে ফেলতে পারলে মন্দ হতো না। শেষমেশ ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খেতে হয়েছে।
নাখালপাড়া থেকে গুলশান যাব। নাবিস্কো রাস্তাটা পার হয়ে গুলশান লিংক রোড দিয়ে হেঁটে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু সে রাস্তা পার হওয়া মানে একটা যুদ্ধ জয় করা। বড় বড় বাস দ্রুতগতিতে চলছে; অন্যান্য যানবাহন তো আছেই। এর মাঝে মানুষ যে যার মতো দৌড়ে, হেঁটে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি এভাবেই আমাদের এলাকায় মানুষজন রাস্তা পার হচ্ছে। আশপাশের কোথাও কোনো ওভারব্রিজ নেই। এখানে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এবার এসে দেখি, এ রাস্তায় একটা ওভারব্রিজ হয়েছে। ব্রিজটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছে আরও মাসখানেক আগে।
অথচ এটি এখনো খুলে দেওয়া হয়নি। এরপর পরিচিত একজনের কাছে জানতে পারলাম, মন্ত্রীর নাকি সময় হচ্ছে না উদ্বোধন করার! চিন্তা করে দেখুন, সামান্য একটা ওভারব্রিজ পর্যন্ত উদ্বোধন করতে হচ্ছে মন্ত্রীকে। এর জন্য দরকার হয় অনন্তকাল অপেক্ষা করতেও কারও কোনো সমস্যা নেই। এদিকে সাধারণ মানুষকে দিন-রাত ভোগান্তির মাঝ দিয়েই যেতে হচ্ছে।
শুনেছি ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের নাকি এখন নিয়মিত কোনো না কোনো ওষুধ খেতে হয়। এটি অবশ্য আশপাশ তাকালেই বোঝা যায়। মুদিদোকানের চেয়ে ফার্মেসির সংখ্যা মনে হচ্ছে এখন বেশি। কেউ বুঝতেই পারছে না এই শহরের মানুষগুলো শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ জীবন যাপন করছে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের আচরণে।
আমাদের ঢাকা শহরটি মরে গিয়েছে। মৃত এই শহরে প্রায় মৃত মানুষগুলো এখন কেবল বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]