মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে এসে আবারও তাঁর পুরোনো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন—ট্যারিফ বা শুল্কের বেড়া। ২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে তিনি ‘জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন। নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর।
৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ ‘বেজলাইন’ শুল্ক বসানো হয়েছে। তবে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য–ঘাটতি বেশি, তাদের ওপর বাড়তি শুল্কও রয়েছে। চীনের জন্য সেটা গিয়ে ঠেকেছে ৩৪ শতাংশে, জাপানের ২৪, দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ আর তাইওয়ানের জন্য ৩২ শতাংশ।
ট্রাম্প যেটা ভাবছেন সেটা হলো, এই শুল্ক দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও কর্মসংস্থানের স্বার্থ রক্ষা করবেন, বাণিজ্যে ‘অন্যায্যতা’ দূর করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁর এই একতরফা কৌশল হয়তো উল্টো ফল দেবে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে ঝুঁকছে একে অপরের দিকে এবং অবশ্যই চীনের দিকেও।
যুক্তরাষ্ট্রের একঘরে হওয়ার সম্ভাবনা
পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো দিন দিন একে অপরের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো মিত্র দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা চাপের মুখে নত হয়নি। তারা বরং নিজেদের মধ্যে ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে মনোযোগ দিচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে অঞ্চলটির ভেতরে আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলো আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি), ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারত্ব চুক্তির পরিমার্জিত রূপ (সিপিটিপিপি) এবং বহুদিন ধরে স্থগিত থাকা চীন-জাপান-কোরিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সিজেকেএফটিএ) গতি বাড়তে পারে।
ট্রাম্প হয়তো ভাবছেন, এতে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি হয়তো নিজেই নিজের দেশকে বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন।
সি চিন পিংয়ের লম্বা দৌড়ের খেলা
এমন পরিস্থিতিতেই আসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নাম। তিনি এই মুহূর্তে কেবল চীনের নেতা নন, বরং ঠান্ডা মাথার হিসেবি কৌশলবিদ। তিনি পরিস্থিতি বুঝে ধৈর্য ধরার পক্ষপাতী। ট্রাম্পের আগ্রাসী বাণিজ্যনীতির জবাবে চীন এখনো তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়নি।চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ‘জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়’ ব্যবস্থা নেবে, তবে তা এখনই নয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কৌশল রয়েছে। সি হয়তো পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষেই ঘুরিয়ে নিতে চাইছেন।
২০২৫ সালের জুনে ট্রাম্প-সি সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগে সি চাপ না বাড়িয়ে বরং হিসাব করে খেলছেন। তাঁর লক্ষ্য পরিষ্কার। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজেদের শুল্কের ফাঁদে পড়ছে। সময়টাকে কাজে লাগিয়ে চীন যদি পূর্ব এশিয়ায় নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে সেটাই হবে আসল জয়।
এই লক্ষ্যে চীন এখন কূটনৈতিকভাবে খুবই সক্রিয়। চীন-জাপান-কোরিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা আবার জোরদার হচ্ছে। ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারত্ব চুক্তির পরিমার্জিত রূপে প্রবেশের ব্যাপারেও চীন একধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে আগে যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
সি চুপচাপ থেকেও খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্প একের পর এক দেশে শুল্ক চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো বন্ধুদের ঠেলে দিচ্ছেন চীনের দিকে। আর তখন সি কোনো হুংকার না দিয়ে চুপচাপ নিজের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছেন।
জাপান ও কোরিয়ার দ্বিধা, চীনের জন্য সুযোগ
জাপান শুল্কে ক্ষুব্ধ। তারা যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, এমনকি নিজ দেশের প্রতিষ্ঠান নিপ্পন স্টিলকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল কোম্পানি কিনে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এত কিছু করেও জাপান ২৪ শতাংশ শুল্কের কবলে পড়েছে।
জাপান যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্কের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিশোধ না নিলেও, এখন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনা জোরদার করছে।
কোরিয়ার পরিস্থিতি জটিল। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বে অস্থিরতা চলছে। প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা হয়েছে। সামরিক আইন নিয়ে বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে আসা–যাওয়া করেছেন একাধিক অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট। এ অবস্থায় কূটনৈতিক জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্যামসাং, হুন্দাইর মতো বড় বড় কোম্পানি মার্কিন বিনিয়োগ বাড়িয়ে শুল্ক এড়াতে চাইছে।
তবু দক্ষিণ কোরিয়া ২৫ শতাংশ শুল্ক এড়াতে পারেনি। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে আমদানির ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। ভিয়েতনামে কোরিয়ান কোম্পানিগুলো বহু পণ্য তৈরি করে। এ অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়াও এখন চীন ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হচ্ছে।
তাইওয়ান সবচেয়ে বিপদে
তাইওয়ান আছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হলেও তারা এখন ৩২ শতাংশ শুল্কের শিকার। তাদের সরকার এই সিদ্ধান্তকে ‘অন্যায্য’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে, তাইওয়ানের সরকার ক্রমাগত চীনের সঙ্গে সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। চীনকে ‘শত্রু রাষ্ট্র’ ঘোষণা, পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। চীনও সামরিক মহড়ার মাধ্যমে জবাব দিচ্ছে।
চলতি বছরই তাইওয়ান ঘিরে চীনের মহড়া আরও ভয়াবহ হয়েছে। চীনা নৌবাহিনী তাইওয়ানের উপকূল ঘেঁষে ঘাঁটি ও বন্দর এবং জ্বালানি অবকাঠামোয় আঘাতের অনুশীলন করেছে।
তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে প্রযুক্তি খাত থেকে। মার্কিন শুল্ক এড়াতে তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি তাদের ১০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এতে তাইওয়ান বিশ্বের প্রযুক্তি সরবরাহ চেইনে তাদের বিশেষ গুরুত্ব হারাতে বসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল, নাকি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত?
ট্রাম্পের যুক্তি হলো, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করছেন। বাণিজ্য–ঘাটতি, মুদ্রা বিপর্যয়, ভ্যাট বৈষম্য—সবই যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে।
কিন্তু সত্যি কি ট্রাম্পের কৌশল কাজ করছে? বরং মনে হচ্ছে, এই শুল্কই যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে করে ফেলছে।
আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব এখন বিশ্বের ৩০ শতাংশ জিডিপি নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারত্বে চীনের প্রবেশ নিয়েও আলোচনা চলছে যেটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তৈরি হয়েছিল চীনকে রুখতে। এখন সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের হাতের বাইরে।
চীন, জাপান, কোরিয়া—এই তিন দেশ আবারও কাছাকাছি আসছে। গত ২২ ও ৩০ মার্চ টোকিও ও সিউলে তাদের বৈঠকে এ বার্তাই এসেছে যে তারা একসঙ্গে মোকাবিলা করবে এই শুল্ক সংকট।
শেষ কথা: সি চিন পিং অপেক্ষা করছেন
সি বিশ্বাস করেন যে সময় তাঁর পক্ষেই কথা বলবে। তিনি চুপচাপ থেকেও খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্প একের পর এক দেশে শুল্ক চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো বন্ধুদের ঠেলে দিচ্ছেন চীনের দিকে। আর তখন সি কোনো হুংকার না দিয়ে চুপচাপ নিজের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছেন।
এই ‘লম্বা সময়ের খেলা’য়, ট্রাম্প হয়তো তাৎক্ষণিক একটুখানি জয় পাবেন। কিন্তু মাঠের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই চলে যাচ্ছে সেই রহস্যময়, নীরব, কিন্তু হিসেবি নেতার হাতে; সি চিন পিংয়ের হাতে।
হাও নান গবেষণা সহকারী, চারহার ইনস্টিটিউট
থিংক চায়না থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ