তুরস্কের জনসাধারণের একটি অংশ আগাম নির্বাচনের পক্ষে। তার মানে হচ্ছে, ২০২৮ সালের আগেই তাঁরা একটা জাতীয় নির্বাচন চান। এর কারণ হলো, ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এ বছরের পৌর নির্বাচনের ফলাফল এই বার্তা দিচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পরের জাতীয় নির্বাচন ২০২৮ সালে হোক কিংবা তার আগে হোক, আমাদের এরদোয়ানের অভিজ্ঞতার বিষয়টিকে মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে ইস্তাম্বুলের মতো নগরের সফল মেয়র ছিলেন এরদোয়ান। এরপর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরদোয়ান তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে এরদোয়ান যখন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সে সময়টা তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য ছিল টালমাটাল একটা সময়। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো একটা স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। যাহোক, এই রাজনৈতিক আবহেই একেপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দলটি ভালোভাবেই দেশ পরিচালনা করতে থাকে।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুর দিক পর্যন্তকে একেপির নীতি নিয়ে খুব কমই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে একেপি জনমত তাদের পক্ষে নেওয়ার জন্য সবকিছুই করে যাচ্ছে। সমর্থন হারানোর পরও এখন পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারার পেছনে তুরস্কের অতি দক্ষিণপন্থী ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টিকে ধন্যবাদ দিতেই পারে তারা। যাহোক, প্রতিটি নতুন নির্বাচনে সমর্থন হারাচ্ছে একেপি।
১৯৯০–এর দশকের শেষ ভাগে তুরস্কের যে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল, সেটাই এরদোয়ানের নেতৃত্বে তথাকথিত সংস্কারবাদী আন্দোলন করতে সহায়তা করেছিল। এ পরিস্থিতিতেই এরদোয়ানের নেতৃত্ব একেপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০২ সালের নির্বাচনে নতুন দল একেপি প্রথমবার অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।
পরবর্তী দুটি নির্বাচনে খুবই স্বচ্ছতার সঙ্গে একেপি নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিল। কিন্তু তৃতীয়বার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দলটির মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়। দলের অনেক সদস্য ভাবতে শুরু করেন, ক্ষমতার সুবিধা তাঁদের ভোগ করা দরকার।
নতুন প্রজন্মের অনেকে তুরস্কের রক্ষণশীল মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। একটা পাথুরে ও একটি কঠিন প্রান্তরের মাঝখানে আটকা পড়া এরদোয়ান ব্যাপক চাপে আছেন। তিনি কি রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর হারানো জনপ্রিয়তা ফেরত আনতে পারবেন? এমন বেকায়দায় পড়ার পরও এরদোয়ান এখনো শক্তিশারী রাজনৈতিক নেতা। তাঁর হাতে এখনো অনেক কিছু, যা দিয়ে তিনি পরিস্থিতিকে তাঁর নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরিতে আরেকটি দিকও ভূমিকা পালন করেছে। সে সময় তুরস্কের জনগণের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা জন্ম হয়েছিল নতুন রাজনৈতিক দল যেন ক্ষমতায় আছে। ২০০২ সালে যখন একেপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল দূষিত। আমি নিজেও একেপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন।
আমার মনে আছে, এরদোয়ান ছিলেন অন্য রাজনৈতিক নেতাদের থেকে স্বতন্ত্র। অনেক কিছুই তিনি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ভিন্নভাবে করতে পারতেন। বিভিন্ন নীতি নিয়ে তিনি যখন বিতর্ক করতেন, তখন আমার কাছে মনে হতো এরদোয়ানের প্রস্তাবটিই অন্যদের চেয়ে ভালো।
যাহোক, বিশ শতকের তৃতীয় দশকে এসে এরদোয়ানের একেপির প্রতি জনসমর্থন কমতে শুরু করে। এ বছরের পৌর নির্বাচনে দলটি বেশির ভাগ আসন হারিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি বেশির ভাগ পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছে। এটা আগামী জাতীয় নির্বাচনে একেপির ব্যর্থতার পূর্বলক্ষণ হতে পারে। রাজনীতিতে আমাদের সব ধরনের বিস্ময়ের জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়, সেটা ভালো হোক আর মন্দ হোক।
ক্ষমতার দ্বিতীয় দশকে এসে একেপির সদস্যদের মধ্যে দুর্নীতি (তুরস্কে সব সময় বড় পরিসরে দুর্নীতি ছিল) বাড়তে শুরু করে। বেশ কিছু গ্যাং লিডার আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা সংস্থা ও রাজনৈতিক অভিজাতদের ব্যবহার করে নিজেদের পথ তৈরি করে নিয়েছে। এরদোয়ান তার দলের ভেতরের এই দুর্বলতার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। একটা বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বড় করে দেখার দৃষ্টি আছে। তুরস্কে তিনি বেশ কিছু বড় প্রকল্পও করেছেন। কিন্তু তুরস্কের জনমতের একটা অংশ প্রচণ্ডভাবে এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করেছে।
এরদোয়ান চিন্তার দিক থেকে রক্ষণশীল। তুরস্কে রক্ষণশীলরাই আধিপত্য করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীলতা আর তুরস্কের রক্ষণশীলতার মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। ১৯২০-এর দশকে কামাল আতাতুর্কের সংস্কারবাদী আন্দোলন তুরস্ককে কিছুটা ভিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেই সংস্কারের যে প্রভাব, তার বিরুদ্ধে তুরস্ককে এখনো লড়াই করতে হচ্ছে।
যাহোক, নতুন প্রজন্মের অনেকে তুরস্কের রক্ষণশীল মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। একটা পাথুরে ও একটি কঠিন প্রান্তরের মাঝখানে আটকা পড়া এরদোয়ান ব্যাপক চাপে আছেন। তিনি কি রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর হারানো জনপ্রিয়তা ফেরত আনতে পারবেন?
এমন বেকায়দায় পড়ার পরও এরদোয়ান এখনো শক্তিশারী রাজনৈতিক নেতা। তাঁর হাতে এখনো অনেক কিছু, যা দিয়ে তিনি পরিস্থিতিকে তাঁর নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম।
ইয়াসার ইয়েকিস তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত