কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি এখন ধ্রুবতারার মতোই সত্য। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীরা তাঁদের আসন অনেকটাই পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। সরকারি, বেসরকারি চাকরি থেকে শুরু করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, চিকিৎসা, প্রকৌশল, গার্মেন্টস, কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজকর্ম, ক্রীড়াঙ্গন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সাংবাদিকতা—এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই।
২০১৯ সালে পরিচালিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি দেখতে ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সবাই।
ধীরে হলেও পরিবর্তন ঘটছে ‘নারী শুধু ঘরের কাজ করবেন’ ধরনের মানসিকতার। কিন্তু কর্মজীবী মা-বাবার শিশুসন্তান তাঁদের অনুপস্থিতিতে কোথায়, কার কাছে থাকবে, সেই জটিল প্রশ্নের উত্তর মিলছে না এখনো।
বিলুপ্ত হতে চলা যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব আর কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের তাগিদ—এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে ঘরের শিশুদের জীবনে নেমে আসছে অনিশ্চয়তা। বাড়িতে শিশুর দেখাশোনার বিষয়টি যেহেতু আমরা এখনো মা-বাবা উভয়ের কাজ বলে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি আর পুরুষের অর্থ উপার্জনের সক্ষমতার সঙ্গে যেহেতু সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি জড়িত, তাই শিশুর নিরাপত্তা আর দেখভালের প্রশ্নে বারবার মাকেই সমঝোতায় আসতে হয়। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের পথটি প্রসারিত হচ্ছে ধীরগতিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
বাস্তবতা হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেভাবে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য অনুকূল অবকাঠামো। এ ক্ষেত্রে অন্যতম বড় একটি প্রতিবন্ধকতার নাম শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে–কেয়ার সেন্টারের অপর্যাপ্ততা। চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টারের সংখ্যা। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬–এর সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশুকক্ষবিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ বা এর অধিক নারী কর্মরত থাকলে এবং তাঁদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশুসন্তান থাকলে তাঁদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশুকক্ষ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কয়টি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ৪০ বা এর অধিক কর্মরত নারী থাকলে ডে–কেয়ার সেন্টার রয়েছে?
দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা ও গুণগত মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো এটিকে শুধু নারীর প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা। অথচ সময় ও পরিস্থিতি বলছে উচ্চবিত্ত–মধ্যবিত্ত–নিম্নবিত্তনির্বিশেষে প্রত্যেক কর্মজীবী মা-বাবা, যাঁদের শিশুসন্তান আছে, তাঁদের জন্য এটি অপরিহার্য
দিবাযত্ন কেন্দ্রের গুণগত মান আরেকটি বড় প্রশ্ন। সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন যে ১১৯টি সরকারি শিশু দিবাযত্নœ কেন্দ্র আছে, সেগুলোর অধিকাংশই বেহাল। খোদ সচিবালয়ের অভ্যন্তরের দিবাযত্ন কেন্দ্রের অবস্থাই যখন নাজুক, তখন বাকি কেন্দ্রগুলোর অবস্থা যে কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিশু একাডেমি, মহিলা অধিদপ্তরসহ সরকারি–বেসরকারি নানা উদ্যোগ নিয়মিত কিংবা বিভিন্ন প্রকল্পের অধীন দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। কিন্তু সংখ্যায় অপর্যাপ্ততা কিংবা নিম্নমানের কারণে দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি।
রাজধানীতে বেসরকারিভাবে বেশ কিছু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলোয় ব্যয় অনেক বেশি। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মধ্যম মানের বেসরকারি কেন্দ্রে ভর্তিতেই লাগছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ফি নেওয়া হচ্ছে। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন ২০২১–এর খসড়া বিধিমালায় বেসরকারি ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক ফি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, বিধিমালাটি চূড়ান্ত হলে নির্ধারিত মাসিক ফি মেনে চলা হয় কি না। অনেক ডে-কেয়ার সেন্টারেই নির্ধারিত ফির বাইরে সরবরাহ করতে হয় শিশুর খাবার, ডায়াপার, প্রসাধনীসহ অনেক কিছু। এসব খাবার ও পণ্যের চাহিদা এবং তার পরিমাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কর্মজীবী মা-বাবারা বাধ্য হয়েই মেনে নেন কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক দাবি। ওদিকে ঢাকার বাইরে বেসরকারি ডে-কেয়ার সেন্টারের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
দিবাযত্ন কেন্দ্র শিশুর পরিবহন মা-বাবার জন্য আরেকটি দুঃস্বপ্নের নাম। ঢাকার দুঃসহ যানজট আর গণপরিবহনে সেবার মানের যে অবস্থা, তাতে শিশুকে প্রতিদিন ডে-কেয়ার সেন্টারে আনা-নেওয়া শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অফিস থেকে পরিবহনসেবা পান—এ ধরনের কর্মীর সংখ্যা হাতে গোনা। তাই যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই কিংবা অফিস থেকে যাঁরা পরিবহনসেবা পান না, তাঁরা সন্তানের জন্য দূরবর্তী ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা ভাবতেই শিউরে ওঠেন।
গার্মেন্টসগুলোয় বাধ্যতামূলক দিবাযত্ন কেন্দ্রের কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোর অস্তিত্ব শুধুই কাগজ–কলমে। শোনা যায়, অডিটের সময় সাজিয়ে তোলা হয় দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো, যা অডিটের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মী কিংবা সেবা দানকারী যেসব নারী অন্যের সংসার-সন্তান সামলানোর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, কিংবা রোজগারের জন্য বাইরে বের হন, তাঁদের নিজেদের ঘরেই সন্তান থাকে সবচেয়ে অরক্ষিত। ফলে বস্তিঘরে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে শিশু ধর্ষণ কিংবা অপহরণের ঘটনাগুলো নিয়মিত হয়ে উঠছে।
দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা ও গুণগত মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো এটিকে শুধু নারীর প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা। অথচ সময় ও পরিস্থিতি বলছে উচ্চবিত্ত–মধ্যবিত্ত–নিম্নবিত্তনির্বিশেষে প্রত্যেক কর্মজীবী মা-বাবা, যাঁদের শিশুসন্তান আছে, তাঁদের জন্য এটি অপরিহার্য। কর্মস্থলে তো বটেই, চাই এলাকাভিত্তিক ডে-কেয়ার সেন্টার।
এতে তীব্র যানজট, প্রতিদিনের বায়ুদূষণ আর গণপরিবহনের বিড়ম্বনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে শিশু এবং তার পরিবার। চাই প্রতিটি বস্তিতে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ডে–কেয়ার সেন্টার; যেন নিম্ন আয়ের মা-বাবা স্বল্প ফিতে শিশুদের সেখানে রাখতে পারেন।
ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিশেষ করে বাণিজ্যিক শহরগুলোয় ব্যাপক চাহিদা আছে ডে-কেয়ার সেন্টারের। সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই ডে-কেয়ার সেন্টার খুলছেন।
কিন্তু প্রচার-প্রচারণার অভাব, ডে-কেয়ার সেন্টার সম্পর্কে সাধারণ জনগণের নেতিবাচক মানসিকতা, সন্তান লালন-পালনের প্রথাগত ধারণা ইত্যাদির কারণে হতোদ্যম হয়ে অনেকেই তা আবার গুটিয়ে ফেলছেন। এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য চাই বিশেষ ব্যবস্থা।
নারী-পুরুষের সমযাত্রাকে অনেকখানি এগিয়ে নিতে পারে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রের প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা। অন্যদিকে শিশুর নিরাপত্তা ও যত্নের মধ্যে নিহিত আছে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ। তাই মানসম্পন্ন ও বিপুলসংখ্যক ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠা এবং তার উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী