প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আবশ্যিকভাবে সবাইকে বাংলা পড়তে হয়। এরপর বাংলায় যাঁরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন, তাঁদের আরও চার-পাঁচ বছর বাংলা পড়তে হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্যান্য বিষয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদেরও সুযোগ রয়েছে কোর্স হিসেবে বাংলা পড়ার। মুশকিল হলো, এই দীর্ঘ সময় বাংলা পড়েও আমরা প্রত্যাশিত মাত্রায় বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারছি না।
বিভিন্ন জরিপ এবং পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা বাংলা ঠিকমতো পড়তেও পারে না। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বিষয় নিয়ে নিজের মতো লিখতে পারে না। মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিকে মাতৃভাষায় নতুন কোনো দক্ষতা যোগ হয় না। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পড়ে কেবল সাহিত্য আর সাহিত্যিক সম্পর্কেই ধারণা লাভ করে। ফলে বাংলায় গ্র্যাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীরাও ভাষাবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সংকট দূর করার উপায় কী? প্রথমত, দরকার একে ‘সংকট’ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। এরপর দরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চতর পর্যায়ের প্রতিটি ধাপের জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা। এই অনুযায়ী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্র ও প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিলে কাজটি অনেক সহজ হয়ে যায়। মূল্যায়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতিতেও এর প্রতিফলন থাকবে।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে ভাষাবিষয়ক প্রচুর অনুশীলনী ও কাজ থাকা দরকার। সেখানে মূল লক্ষ্য হবে দ্রুত পড়তে ও লিখতে শেখানো। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা পড়ানোর সুবিধা হলো, শিশু কথা বলতে শিখেই বিদ্যালয়ে আসে। তাকে প্রমিত কথোপকথনে অভ্যস্ত করে তুলতে চাইলে এ সময়েই উচ্চারণের কাজ শুরু করা উচিত।
পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে তাকে নতুন ও জটিল শব্দের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। ছোট বাক্য থেকে ক্রমান্বয়ে বড় বাক্য পড়তে ও লিখতে শেখাতে হয়। সে জন্য প্রতিটি শ্রেণিতেই পাঠ তৈরি ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শব্দের ধরন ও বাক্যে শব্দের সংখ্যা বিবেচনায় নিতে হবে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে সারসংক্ষেপ তৈরি করতে পারা, ব্যাখ্যা করতে পারা এবং নিজের মতো লিখতে পারার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবে সেটি শুরু হবে প্রাথমিক পর্ব থেকেই। মাধ্যমিকে সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর কাজটিও করতে হবে। তবে প্রমিত ভাষা শেখানোই যেহেতু উদ্দেশ্য, সেহেতু পাঠ বা লেখা নির্বাচনে এর প্রতিফলন থাকবে। তথ্য ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করার কৌশল শেখাতে হবে। আলাদা বই হিসেবে মাধ্যমিকে ব্যাকরণ থাকতে পারে, তবে তা যেন শিক্ষার্থীর ভাষার প্রয়োগদক্ষতা বাড়ায়।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনকে মাথায় রেখে পাঠ্যক্রম সাজানো উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে পারে দাপ্তরিক যোগাযোগ, অভিভাষণ তৈরি, ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ, ভাষা সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়।
ভাষা সম্পাদনার মধ্যে গুরুত্ব পাবে প্রুফ রিডিং, বাক্য ভাঙা ও জোড়া দেওয়া, যতিচিহ্নের ব্যবহার, বিকল্প শব্দের প্রয়োগ ইত্যাদি। এ পর্যায়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশ করা ও বিশ্লেষণমূলক লেখা তৈরি করার সুযোগ রাখতে হবে। বই, গল্প-কবিতা, নাটক, সিনেমা ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কৌশল শেখাতে হবে।
উচ্চতর পর্যায়ে কিছু দ্বান্দ্বিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। যেমন ব্যাকরণ ও ভাষা বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতের অভিমত এবং এ বিষয়ে তর্ক শিক্ষার্থীদের জানানো দরকার। তাহলে ভাষাবিষয়ক মৌলিক তত্ত্ব ও ধারণা তাদের কাছে স্পষ্ট হবে।
হাজার বছরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে বিবর্তন হয়েছে, তার পথরেখাটি দেখাতে হবে। বড় অনুবাদের অনুশীলন করাতে হবে। পরিভাষা তৈরির মূলনীতি ও পদ্ধতি শেখাতে হবে। অভিধানের বৈচিত্র্য ও প্রণয়নকৌশল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সাহিত্য সমালোচনায় দক্ষ করে তুলতে হবে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, গ্রন্থ প্রকাশ, স্ক্রিপ্ট রচনা, নাটক মঞ্চায়ন, বিজ্ঞাপন ও প্রচারপত্র তৈরি ইত্যাদি কাজেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা বিষয়ে পাঠদানের ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয় না। কেবল কোর্স অনুযায়ী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা আছে। অথচ পাঠ্যক্রম তৈরির আগে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার দরকার ছিল। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে কোর্সগুলো সাজানো যেতে পারে। এমনকি উচ্চতর পর্যায়ের প্রশ্নপদ্ধতি নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, বছরের পর বছর ধরে একই ধরনের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পুরোনো নোট বা ফটোকপি মুখস্থ করেই ডিগ্রি অর্জন করেন।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগের কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। এর ভিত্তি হিসেবে ভাষাশিক্ষণের ব্যাপারে জোর দিতেই হবে। বাংলা ভাষার জন্য আবেগের ফুলঝুরির চেয়ে বেশি প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকেই এর সূচনা করতে হবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক